নিউজ ডেস্ক,শুক্রবার,১১ মে ২০১৮:
সুন্দরবন, গোলপাতা আর লতাগুল্মের নান্দনিকতা। আছে চোখ জুড়িয়ে যাওয়া রয়েল বেঙ্গল টাইগার, কতশত পশু-পাখির কিচির-মিচির। এতসব সৌন্দর্যের লীলাভূমিতেও বাস করে ভয়, আতঙ্ক।
না, বাঘে ধরবে, সাপে কাটবে— এ আতঙ্ক নয়। আতঙ্ক মানুষ নামের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণীকে নিয়ে, সুন্দরবনে যাদের নাম দেয়া হয়েছে বনদস্যু। এরা অগ্নিশর্মা চোখে রাত-বিরাতে অবিরত ছুটে চলে, হাতে আগ্নেয়াস্ত্র। বারুদ পুড়িয়ে অন্যের স্বপ্ন কাড়ে, বোনে নিজের স্বপ্ন।
এদের কেউ ইচ্ছে করে বনদস্যু। কেউ বাধ্য হয়ে। কেউ বা প্রতিশোধের আগুন নেভাতে গিয়ে অন্ধকার গহ্বরে ডুবে গেছেন। দিন শেষে তাদেরও ভাবনায় আসে— আমি ভালো হব, অন্য সবার মতই সংসারী হব। মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সুখের দিন গড়ব। কিন্তু, দস্যুতা জীবনের একটিই পিছুটান_ একবার যে এ পথে পা বাড়ায়, ফিরে যাওয়ার থাকে না উপায়। মরে না হয় মেরে টিকে থাকে।
এতেই কী জীবনের সমাপ্তি! না, দিনশেষে যে সুখ স্মৃতিগুলো সম্পদ, সেখান থেকেই দস্যুরাও ফিরে আসতে চায় স্বাভাবিক জীবনে? হয় তো চায়, হয় তো না!
ভুল পথে সুন্দরবনের এসব স্বপ্ন বুনে চলা দস্যুগুলোর জন্যই আলোকবর্তিকা হয়ে আসেন মোহসীন-উল হাকিম। পেশাগত দায়িত্বের বাইরেও যিনি গভীরে ভেবেছেন দস্যুদের একান্ত কষ্টগুলো। তাই তো বেসরকারি টেলিভিশন যমুনা টিভি’র এই বিশেষ প্রতিনিধি এগিয়ে গেছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে সুন্দরবনের আতঙ্ক দস্যুদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন।
ইতোমধ্যে অনেকে ফিরে এসেছেন। আরও অনেকে আসার প্রক্রিয়ায় আছেন। কিন্তু, তাদের ফেরানোর পথে তাকে কতশত দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। জীবনকে হাতের মুঠোয় নিতে হয়েছে। গহীন বনে না খেয়ে, না নেয়ে ঘুরতে হয়েছে। এরই মাঝে কোনো দস্যুর জীবনের গল্প শুনে হয়তো কেঁদেছেন, কারোটাতে ক্রোধে জ্বলেছেন। সে সব ক্ষুদ্র হাসি- কান্না, দুঃখ-বেদনা আর জীবন নিয়ে জীবন গড়ার জমিয়ে রাখা স্মৃতিগুলো মোহসীন-উল হাকিম ‘জীবনে ফেরার গল্প’ শিরোনামে পাঠকদের জানিয়েছেন—
জীবনে ফেরার গল্প-০৮
দস্যু সেরাজ ফোনে বলল, মামা, আমাদের দলের একটা নাম রাখা দরকার। বললাম, কী নাম রাখতে চাও? উত্তরে সেরাজ বলল, আল্লাহর দান রাখলে কেমন হয়? আমি হাসব, না কাঁদব! বকা দিয়ে বললাম, এসব নাম চলবে না।
সেরাজ বলল, ঠিক আছে মামা, আমরা আবার বসে আলোচনা করে একটা নাম ঠিক করে জানাচ্ছি। বিকেলে আবার ফোন দিবে বলে সে রেখে দিল।
আধা-ঘণ্টার মধ্যে আবারও ফোন আসল। এবার ফোনে বাহিনী প্রধান ছোট রাজু। বললেন, ও ভাই… তো বাহিনীর নাম মায়ের দোয়া রাখলে কেমন হয়? এবার আরও জোরে বকা দিয়ে বললাম, আপনারা কি মাছ ধরার ট্রলার নামাচ্ছেন? নাকি মুদির দোকান দিচ্ছেন? করেন ডাকাতি, আর নাম দিতে চান মায়ের দোয়া? বললাম, আপনি এই দস্যুদলের নেতা। আপনার নামেই থাকুক দলের নাম। সেই থেকে এই দস্যু বাহিনীর নাম ছোট রাজু বাহিনী।
সেই সময়ের সবচেয়ে বিপজ্জনক দস্যু জাহাঙ্গীর বাহিনী থেকে পালিয়ে আসে ছোট রাজু। সেরাজ, ম্যাজিক বিল্লাল, আফজাল সরদারসহ ৮/১০ জনের এই দস্যু দলটি পূর্ব সুন্দরবনের বেশ কিছুটা জায়গা নিয়ে দস্যুতা শুরু করে ২০১৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে। তবে মাস দু’একের মধ্যেই তারা সারেন্ডারের জন্য প্রস্তুত হয়।
জাহাঙ্গীর বাহিনী থেকে দল ভেঙে বেরিয়ে আসার কারণ ছিল কয়েকটি। তবে মূলত আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নিয়েই বিভাজন তৈরি হয়। ছোট রাজু ও তার সঙ্গীরা আত্মসমর্পণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু, তাদের লিডার তখন আত্মসমর্পণে আগ্রহী ছিল না মোটেই (অবশ্য এই জাহাঙ্গীর বাহিনীও পরে আত্মসমর্পণ করে)।
যাই হোক, ছোট রাজু বাহিনীকে র্যাব হেফাজতে নিতে নির্দিষ্ট দিনে মংলা থেকে রওনা হই আমরা। সেবার সঙ্গী যথারীতি বায়েজিদ ইসলাম পলিন, আহসান রাজিব, ইয়ামীন আলী, সরদার সুমন ও আমাদের সব সময়ের পাইলট বেলায়েত সুন্দরবন। আর সেই যাত্রায় ঢাকা থেকে সঙ্গী হয়েছিলেন আমার সবচেয়ে প্রিয় অনুসন্ধানী সাংবাদিক আবু সুফিয়ান ভাই।
সুন্দরবনের চরাপুটিয়া অফিসের সামনে র্যাবের লঞ্চ রেখে আমরা এগিয়ে গেলাম ছোট রাজুর আস্তানার দিকে। নির্দিষ্ট খাল ধরে নিচের দিকে নামতে থাকলাম। ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই টর্চ লাইটের সিগন্যাল বিনিময় হলো। কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে আমরা ফিরে আসলাম চরাপুটিয়া অফিসের সামনে। র্যাবের হেফাজতে উঠে এল দস্যুদল ছোট রাজু বাহিনী। বিলুপ্ত হলো সুন্দরবনের আরেকটি দস্যু বাহিনী।
সেই দফায় র্যাবের যে দলটি গিয়েছিল, তার নেতৃত্বে ছিলেন র্যাব-৮ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আনোয়ার। সঙ্গে ছিলেন সুন্দরবনের দস্যুদের ত্রাস ও ভরসা মেজর আদনান কবীর।
ছোট রাজু এখন খুলনার ভৈরব নদীতে মাছ ধরেন। মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন তার দলের সেকেন্ড-ইন কমান্ড সেরাজের সঙ্গে। সেরাজ এখন মাছের ব্যবসা করে। দলের বাকি সদস্যরাও এখন যার যার মত করে সংসার চালাচ্ছে।
এদের সবার বাড়িতে আমার একদিন করে দাওয়াত খাওয়ার কথা ছিল। রাজহাস ভুনা আর ঘেরের তাজা চিংড়ি এবং পারসে মাছের দাওয়াত। কিন্তু, সময় পাইনি বলে সেই দাওয়াত খাওয়া শুরু করতে পারিনি এখনও।
সূত্র: পরিবর্তন ডটকম