নিউজ ডেস্ক,শুক্রবার,১৮ মে ২০১৮:
ঢাকা শহরের পুরান ঢাকার লালবাগ এলাকায় ঐতিহাসিক লালবাগ কেল্লা অবস্থিত। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, লালবাগ কেল্লার আসল নাম ছিল কিল্লা আওরঙ্গবাদ। মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের তৃতীয় পুত্র যুবরাজ আজম শাহ বাংলার সুবেদার হয়ে ১৬৭৮ সালে ঢাকায় আসেন। তৎকালীন সময়ে সাধারণত দুর্গ নির্মিত হতো আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য। তবে লালবাগ দুর্গের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি ছিল কিছুটা ভিন্ন।
যুবরাজ আজম শাহের উৎসাহ ছিল নতুন নতুন স্থাপত্য নির্মাণের। তিনি বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে এই প্রাসাদ দুর্গ নির্মাণে হাত দেন। যুবরাজ আজম শাহ তার পিতাকে সম্মান দেখিয়ে এটির নামকরণ করেন ‘কিল্লা আওরঙ্গবাদ’। কিন্তু তিনি এই দুর্গটির নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করতে পারেননি। কারণ ১৬৭৯ সালে মারাঠাদের মোকাবিলার জন্য সম্রাট আওরঙ্গজেব তাকে দিল্লী ডেকে পাঠান। ফলে প্রাসাদ দুর্গটির নির্মাণ কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই তাকে ঢাকা ত্যাগ করতে হয়।
১৬৮০ সালে শায়েস্তা খান দ্বিতীয়বার বাংলার সুবেদার হয়ে ঢাকায় আসেন। সুবেদার শায়েস্তা খান ছিলেন একজন দক্ষ শাসক, বিচক্ষণ কূটনীতিক ও বীরযোদ্ধা। তিনি দুই দফায় সুদীর্ঘ ২৪ বছর বাংলায় সুবেদারের দায়িত্ব পালন করেন।
সুবেদার শায়েস্তা খান ঢাকা এলে সম্রাট আওরঙ্গজেব তাকে অসমাপ্ত দুর্গ “কিল্লা আওরঙ্গবাদ”এর স্বত্ব দান করেছিলেন। যুবরাজ আজম শাহও তাকে ‘কিল্লা আওরঙ্গবাদ’ প্রাসাদের নির্মাণ কাজ শেষ করার জন্য অনুরোধ করেন। সুবেদার শায়েস্তা খান ব্যক্তিগতভাবে এর মালিক হওয়ায় আবার নতুন করে দুর্গের নির্মাণ কাজ শুরু করেন এবং তিনিই তা সমাপ্ত করেন। তারপর তিনি দুর্গটির নাম পরিবর্তন করে লালবাগ কেল্লা নামকরণ করেন, যা এখনো প্রচলিত।
আবার অনেকের মতে, সুবেদার শায়েস্তা খান ব্যক্তিগতভাবে এই দুর্গের মালিক হওয়া সত্ত্বেও এ দুর্গের প্রতি তেমন কোনো আগ্রহবোধ করেননি।
জনশ্রুতি অনুযায়ী এর কারণ, বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খান লালবাগ দুর্গের নির্মাণ কাজে হাত দিলে এর কিছুদিন পর তাঁর অতি আদরের কন্যা পরী বিবির (ইরান দূখত) মৃত্যু হয়। কন্যার মৃত্যুতে তিনি গভীরভাবে শোকাহত হন। পরী বিবির বিয়ে হওয়ার কথা ছিল যুবরাজ আজম শাহের সঙ্গে। তাই সুবেদার শায়েস্তা খান ভেবেছিলেন, দুর্গটি অপয়া। আর এজন্য তিনি লালবাগ দুর্গের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করেননি।
সুবেদার শায়েস্তা খান দুর্গের কাজ বন্ধ করে দেন। তার পরিবর্তে একটি দরবার হল নির্মাণ করেন। এবং দুর্গের মাঝখানে পরী বিবিকে সমাহিত করে, তার ওপর নির্মাণ করেন দৃষ্টিনন্দন একটি সমাধিসৌধ। শোককে সৌন্দর্যে পরিণত করেন শায়েস্তা খান।
পরীবিবির সমাধিসৌধের নির্মাণশৈলী অনুপম ও নির্মাণসামগ্রী অতি মূল্যবান। এই একটি মাত্র ইমারতে মার্বেল পাথর, কষ্টি পাথর ও বিভিন্ন রংয়ের ফুল, পাতা সুশোভিত চাকচিক্যময় টালির সাহায্যে অলংকৃত করা হয়েছে। এই পরী বিবির সৌধের ভেতরে আছে ছোট বড় নয়টি কক্ষ।
অভ্যন্তরীণ কক্ষগুলোর ছাদ করবেল পদ্ধতিতে কষ্টি পাথরের তৈরী। তবে এর কেন্দ্রীয় কক্ষটি বেশ বড়। আর এই কেন্দ্রীয় কক্ষের মাঝখানেই রয়েছে পরী বিবির সমাধি। এই সমাধি কক্ষের চারদিকেও রয়েছে চারটি দরজা। মূল সমাধি সৌধের কেন্দ্রীয় কক্ষের উপরের কৃত্রিম গম্বুজটি তামার পাত দিয়ে আচ্ছাদিত। উল্লেখ্য, সমাধিটির সৌধ ২০.২ মিটার বর্গাকৃতির।
পরী বিবির সমাধির দক্ষিণ-পূর্ব কোণের কক্ষে ছোট আকারের একটি সমাধি আছে। এই সমাধিটি সুবেদার শায়েস্তা খানের পালিত কন্যার। এছাড়াও শায়েস্তা খানের একান্ত বিশ্বস্ত সহ-সেনা অধিনায়ক খোদাবন্দের (মির্জা বাঙালি) সমাধি রয়েছে এখানে। মির্জা বাঙালির সমাধি দুই পাশে রয়েছে নাম না জানা আরো দুইটি সমাধি। সৌধের ভেতরে আলো বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রয়েছে।
কিল্লার চারকোণে চারটি অষ্টকোণ উঁচু মিনার আছে। মিনারের শীর্ষ ছোট গম্বুজ দ্বারা সুশোভিত। সৌধের ঠিক মাঝখানে একটি গম্বুজ আছে। সৌধের চারদিকে আছে একটি করে মোট চারটি দরজা। দরজাগুলো খাঁজকাটা মিনার দিয়ে বেষ্টিত। পরী বিবির সমাধি সৌধের বাহ্যিক সৌন্দর্যের চেয়ে এর ভেতরের সৌন্দর্য বেশি মনোমুগ্ধকর। সৌধের ভেতরে মার্বেল পাথর, বেলে পাথর ও কালো পাথরের কারুকাজ অত্যন্ত বিস্ময়কর।
লালবাগ দুর্গের আয়তন প্রায় ১৯ একর। এর ভিতরে পরীবিবির সমাধিসৌধ ছাড়াও রয়েছে দরবারগৃহ, হামাম খানা, পুকুর, মাটির ঢিবি, দুর্গ, মসজিদ, পানির নল, ফোয়ারা প্রভৃতি।
কেল্লার দক্ষিণ এবং পশ্চিমে দাঁড়িয়ে আছে সুদীর্ঘ দুর্গ প্রাচীর। দুর্গ প্রাচীরের নির্দিষ্ট দূরত্ব পর পর একটি করে পলকাটা তোপমঞ্চ। এই তোপমঞ্চের কাজ কী ছিল, জানতে ইচ্ছে করছিল খুব। খুঁজেপেতে যা পেলাম তা হলো, কামানের অপর নাম তোপ। তারমানে তোপমঞ্চ হলো কামান রাখার মঞ্চ। এই মঞ্চের মধ্যে কামান রেখেই শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করা হতো!
আংশিক ধ্বংসপ্রাপ্ত কিন্তু খুব মজবুত এই দুর্গ প্রাচীরের উপরে ওঠা যায়। সত্যি বলতে কী, কিল্লার পুরো এলাকাটা ভালোভাবে দেখা যায় এই দুর্গ প্রাচীরের উপরে দাঁড়িয়েই। আমরা প্রাচীরের একদম শেষ সীমানায় গিয়ে মাটির ঢালুমতোন একটা জায়গা দিয়ে উপরে উঠেছিলাম।
তাঁর শাসনামলেই আরাকান জলদস্যুদের পরাজিত করে চট্টগ্রাম বন্দর মুক্ত করা হয়। সে সময়ে বাংলায় ব্যাপক সমৃদ্ধি ঘটেছিল। তিনি এ দেশে বহু জনহিতকর কাজও করেছিলেন। অন্য সব সাফল্যের সঙ্গে এই লালবাগ কেল্লার ভিতরে পরী বিবির সমাধিসৌধ তাকে অমর করে রেখেছে।
ইটালাল রঙের এই সমাধি সৌধটি কালো পাথরে বাঁধানো একটি অনুচ্চ প্লাটফর্মের ওপর নির্মিত হয়েছিল। সে সময়ে রঙ লালচে থাকলেও প্রতিবার সংস্কারের সময় কেল্লাটিতে নতুন নতুন রঙ করা হয়। কখনো গোলাপি, কখনো বাদামী। কিন্তু এই পুরাকীর্তিগুলোর আসল সৌন্দর্য এগুলোর নিজস্ব ইটা লালচে রঙেই সবচেয়ে বেশি ফোটে। প্রত্নতত্ত্ববিদগণের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, এগুলোকে একেক সময়ে একেক রং করার মধ্যে কোনো যৌক্তিকতা নেই। বাদামী রংটা দেখেই কেন যেন মনটাই খারাপ হয়ে গেল।
লালবাগ দুর্গ যখন লালবাগ অঞ্চলে নির্মাণ করা হয়, তখন বুড়িগঙ্গা নদীর যৌবনকাল। ফলে বুড়িগঙ্গা বয়ে যেত এই দুর্গের পাশ দিয়ে। দুর্গটি প্রাচীরবেষ্টিত। কয়েকটি তোরণ ছাড়া দুর্গের চৌহদ্দির মধ্যে যা আছে, তা সম্পর্কে তো বললামই। দুর্গটির পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় দুই হাজার ফুট এবং উত্তর-দক্ষিণে প্রায় আটশ ফুট চওড়া। বুড়িগঙ্গা নদী বয়ে যেত এর দক্ষিণ দিক দিয়ে।
কালের বিবর্তনে এখন বুড়িগঙ্গা নদী দূরে সরে গেছে। এই লালবাগ দুর্গের দুর্গ ভবনের দক্ষিণ দিকে এর প্রধান তোরণ বা প্রবেশ পথ। এটি শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণরূপে তৈরি করা হয়নি। অসমাপ্ত তোরণটি এখনো পর্যন্ত তেমনি আছে। কিন্তু এ দুর্গটির নির্মাণ কাজ এতই শৈল্পিক যে, এর অসম্পূর্ণতা অতি সহজে ধরা যায় না।
দুর্গের মূল ভবনটি তিন তলা। এই তিন তলা ভবনের নিচ তলার মাঝখান দিয়ে বের হওয়ার এবং প্রবেশ করার একটি পথ আছে। এখানে প্রবেশ পথে আরেকটি তোরণ আছে। সেটিই এখনো সদর তোরণ হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। অর্থাৎ দর্শকরা এ তোরণ দিয়েই মূল ভবনে প্রবেশ করেন। অতি মূল্যবান সুদৃশ্য পাথর দ্বারা এ তোরণটি নির্মিত। এ দুর্গটির মূল ভবনের পাশেই আরো একটি দোতলা ভবন রয়েছে। যতোদূর জানা যায় যে, এই ভবনের ওপর তলায় ছিল দরবারগৃহ। এখানেই তৎকালীন সময় রাজ্যের বিচারসহ রাজ্যের যাবতীয় রাজকার্য চলতো।
এর নিচ তলায় ছিল হাম্মাম খানা বা গোসলখানা। এই হাম্মাম খানায় তৎকালে রাজ পরিবারের সবাই, বিশেষ করে মহিলারা গোসল করতেন। এমনকি সে সময় গোসলের জন্য বিভিন্ন উত্তাপের গরম ও ঠাণ্ডা পানির ব্যবস্থা থাকত। হাম্মাম খানায় সবসময় সুগন্ধিতে ভরপুর থাকত। এছাড়া শরীরে মাখার জন্য বিভিন্ন ধরনের বিদেশী সুগন্ধিও সেখানে মজুদ থাকত।
এই দুর্গের ভিতরে একটি পুকুর ছিল। পুরো পুকুরটিতে এখন সবুজ ঘাসে ছেয়ে থাকে। এই পুকুরটি কখনো গোসল অথবা এ ধরনের কোনো কাজে ব্যবহৃত হতো না, যদিও এ উদ্দেশ্যেই পুকুরটি খনন করা হয়েছিল। পুকুর পাড়ের রেলিংয়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম, পুরো পুকুরটি কী করে এমন ঘন সবুজ ঘাসে ছাওয়া হতে পারে! তখনো অবশ্য জানি না, এটি কখনো ব্যবহারই করা হয়নি! চারদিক ঘাট বাঁধানো বর্গাকৃতির পুকুরটির সিঁড়িও রয়েছে।
১৬৮৮ সালে শায়েস্তা খান সুবেদারি পদ থেকে অবসর নিয়ে আগ্রা গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। সুবেদার শায়েস্তা খান এখান থেকে চলে যাবার পরপরই ঢাকার রাজনৈতিক গুরুত্ব ধীরে ধীরে কমতে থাকে। ১৭০৪ সালে বাংলার রাজধানী ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তর করা হয়। এরপর থেকেই এই লালবাগ দুর্গটি অবহেলার শিকার হয়।
১৮৫৩ সালে ঢাকার পুরানা পল্টন থেকে সেনানিবাস স্থানান্তরিত করে লালবাগ দুর্গটি সেনানিবাস হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত সেনানিবাস এখানে ছিল। ১৮৫৭ ও ১৯৪৮ সালে ঘটেছিল দুটি করুণ রক্তাক্ত ঘটনা। ঘটনাগুলো কী, জানতে পারলাম না। ইতিহাস আর ঐতিহাসিক জিনিসের প্রতি আমার অমোঘ টান। বহু ঘাঁটাঘাটি করে আবুল আসাদের “একশ বছরের রাজনীতি” বইটা পেলাম। ওটা পড়ে জানতে পারলাম,
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ অর্থাৎ স্বাধীনতা সংগ্রামে ইংরেজ বিরোধী বিদ্রোহ তৎপরতায় মুসলমানদের ভূমিকা ছিল মুখ্য। কিন্তু এ সংগ্রাম বাংলাদেশে গণরূপ পাবার আগেই শেষ হয়ে যায়। তবু ঢাকার লালবাগ দুর্গে কমপক্ষে ৪০ জন বাঙালি বিদ্রোহী সৈনিক জীবন দেয়, ফাঁসিতে জীবন দেয় আরও বহু। এদেরই পুণ্য স্মৃতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গিত আজকের বাহাদুর শাহ পার্ক।
কিন্তু ১৯৪৮ সালে লালবাগে কী ঘটেছিল, তা আর জানতে পারিনি।
কালের পরিবর্তনে এই দুর্গটি অবহেলা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ছিল দীর্ঘ বছর। সেই সঙ্গে পরী বিবির সমাধিসৌধ অযত্নে-অবহেলায় পড়ে ছিল। ১৮৯৭ সালে প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পের পরেও পরী বিবির সমাধিসৌধ বিস্ময়করভাবে টিকে ছিল। অনেকগুলো বছর পেরিয়ে যাবার পর লালবাগ দুর্গ সংস্কার করে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে।
লালবাগ কেল্লায় মোট তিনটি ফটক আছে যার মধ্যে দুইটি বর্তমানে বন্ধ। ভেতরে প্রবেশ করলেই বাগান ঘেরা স্নিগ্ধ পরিবেশ মনকে শান্ত করে দেয়। দুর্গের আঙ্গিনায় কয়েকটি সুড়ঙ্গ পথ আছে। এগুলোতে দর্শনার্থীদের প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। কথিত আছে, ওসব সুড়ঙ্গতে ঢুকে কেউ বেরুতে পারেনি। এমনকি কুকুরের গলায় চেইন বেঁধেও ঢোকানো হয়েছিল, ছেঁড়া চেইন ফিরে এলেও কুকুরটি ফিরে আসেনি।
এছাড়াও দর্শনীয় জিনিসগুলোর মধ্যে লালবাগ কেল্লা মসজিদ উল্লেখযোগ্য। সম্রাট আওরঙ্গজেবের ৩য় পুত্র শাহজাদা আজম বাংলার সুবাদার থাকাকালীন এই মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন ১৬৭৮-৭৯ খ্রিষ্টাব্দে। তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটি এদেশের প্রচলিত মুঘল মসজিদের একটি আদর্শ উদাহরণ। এখনো মসজিদটি মুসল্লিদের নামাজের জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
এছাড়া শায়েস্তা খানের বাসভবনের পাশে একটি কামান বা তোপ রাখা আছে যা সেসময়ে বিভিন্ন যুদ্ধে ব্যবহৃত হতো।
(Collected from Google)