নিউজ ডেস্ক,২৭ আগস্ট ২০১৮:
আজ ১২ ভাদ্র, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪২তম মৃত্যুবার্ষিকী। বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত এ মনীষা ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের (১৯৭৬ সাল) এই দিনে ৭৭ বছর বয়সে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (সাবেক পিজি হাসপাতাল) শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়।
জাতীয় কবির মৃত্যু দিবসে রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হয়ে আসছে। এবারও জাতীয় কবির মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বিভিন্ন সংগঠন নানা কর্মসূচির আয়োজন করেছে।
বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে সপ্তম অষ্টম দশক পর্যন্ত কাজী নজরুল ইসলাম শোষণ-বঞ্চনা-নিপীড়ন ও ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে তার কবিতার মাধ্যমে মশাল জ্বেলেছিলেন। আবার প্রেম আর বিরহের এমন মর্মস্পর্শী কবিতা আর গানের প্লাবন এনেছিলেন বাংলা সাহিত্যে, যা তুলে দিয়েছে তার হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর রণতূর্য। এই প্রেম ও বিদ্রোহের শাশ্বত বাণীর স্রষ্টা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কবির নাম কাজী নজরুল ইসলাম।
অসাম্প্রদায়িকতার বরপুত্র ও সাম্যবাদী চেতনার ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষ ছিলেন তিনি। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৩০৬ সালের ১১ জ্যৈষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ডাক নাম ‘দুখু মিয়া’। পিতার নাম কাজী ফকির আহমেদ ও মাতা জাহেদা খাতুন।
বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত হলেও তিনি ছিলেন একাধারে কবি, সংগীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, গায়ক ও অভিনেতা হিসেবে নিজের দক্ষতা, যোগ্যতা ও মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি বৈচিত্র্যময় অসংখ্য রাগ-রাগিণী সৃষ্টি করে বাংলা সঙ্গীত জগৎকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন।
প্রেম, দ্রোহ, সাম্যবাদ ও জাগরণের কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ও গান শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রামে জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর গান ও কবিতা ছিল প্রেরণার উৎস। নজরুলের কবিতা, গান ও সাহিত্য কর্ম বাংলা সাহিত্যে নবজাগরণ সৃষ্টি করেছিল। তিনি ছিলেন, অসাম্প্রদায়িক চেতনার পথিকৃৎ লেখক। তাঁর লেখনি জাতীয় জীবনে অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। তাঁর কবিতা ও গান মানুষকে যুগে যুগে শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির পথ দেখিয়ে চলছে।
দারিদ্র্যের কারণে তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বেশিদূর এগোয়নি; কিন্তু প্রতিভাবান নজরুল নিজের চেষ্টায় প্রচুর পড়াশোনা করে সমৃদ্ধ করেছেন তার মনন ও চিন্তার জগৎ। ছোটবেলায় রুটির দোকানে কাজ করা, লেটোর দলে যোগদান, যৌবনে যুদ্ধযাত্রা, সাংবাদিকতা, রাজনীতিতে সংশ্লিষ্টতা সব মিলিয়ে বিচিত্র আর বর্ণাঢ্য ছিল তার জীবন। বাংলা কাব্যের ইতিহাসে ‘বিদ্রোহী’ এবং আধুনিক বাংলা গানের ‘বুলবুল’ খ্যাত এ কবি বিশ ও ত্রিশের দশকে অবিভক্ত বাংলার, এমনকি উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক জগতের সবচেয়ে বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
নজরুল তার কবিতা, গান, সাংবাদিক-রচনা, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, উপন্যাসসহ অন্যান্য লেখনী এবং রাজনৈতিক কর্মকা-ের মধ্য দিয়ে পরাধীন ভারতে বিশেষ করে অবিভক্ত বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা, সামন্তবাদ, সাম্রাজ্য ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বলিষ্ঠ ও সোচ্চার কণ্ঠ ছিলেন। সে কারণে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তার লেখনী ধূমকেতুর মতো আঘাত হেনে জাগিয়ে দিয়েছিল ঘুমন্ত ভারতবাসীকে। গণবিদ্রোহ সৃষ্টিতে ইন্ধন জোগানোর অভিযোগে ইংরেজ সরকার তার একাধিক গ্রন্থ ও রচনা করেছে বাজেয়াপ্ত, তাকে নিক্ষেপ করেছে কারাগারে।
কারাগারেও চিরবিদ্রোহী ছিলেন, প্রতিবাদ করেছিলেন ব্রিটিশ সরকারের জেল-জুলুমের। ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসক-শোষকদের ভিত্তিমূল কাঁপিয়ে দিয়েছিল তার আগুনঝরা কবিতা আর শেকল ভাঙার গান। ‘বিদ্রোহী’, ‘অগ্নিবীণা’, ‘বিষের বাঁশী’, ‘ফণীমনসা’, ‘ভাঙার গান’, ‘সাম্যবাদী’, ‘প্রলয় শিখা’র মতো কবিতার ঝঙ্কারে শুধু শোষক-শাসকের ভিত্তিমূলই কাঁপেনি, কেঁপে উঠেছিল সমগ্র বাংলাও। কারণ এমন কবিতা বাঙালি এর আগে কখনও শোনেনি।
প্রেমের কবিতায়ও নিয়ে এলেন যেন নতুন জোয়ার। ধর্মান্ধতা, নারীর প্রতি বৈষম্য, সমাজের নিচু শ্রেণীর মানুষদের উপেক্ষা আর ধর্মীয় কূপম-ূকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন বিদ্রোহী কবি। তাই শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও আজও তিনি প্রবলভাবে প্রাসঙ্গিক। আজও মৌলবাদ, ধর্মান্ধতা আর ধনী-দরিদ্রে দ্বিধাবিভক্ত সমাজে, শোষক আর শোষিতে বিভাজিত পৃথিবীতে তার কবিতা, গান, প্রবন্ধ, গল্প-উপন্যাসসহ বিচিত্র রচনা মানবমুক্তির প্রেরণা জোগায়। তাই তিনি তার গানে লিখতে পেরেছিলেন ‘আমারে দেব না ভুলিতে’।
সত্যিই তাকে ভোলা অসম্ভব। কারণ বাংলা কাব্য আর গানে তিনি এনেছিলেন নতুন জোয়ার। ১৯৪২ থেকে বিদ্রোহী কবি নির্বাহ হয়ে যান। নির্বাক থাকেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। ১৯৭২ সালের ২৪ মে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগেই কবি কাজী নজরুল ইসলামকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। সরকার তাকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করে এবং জাতীয় কবি হিসেবেও ঘোষণা দেয়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশেই ছিলেন। তার জীবনকাল ৭৭ বছরের হলেও ১৯৪২ সালের জুলাই থেকেই তিনি অসুস্থ ছিলেন। দীর্ঘ ৩৪ বছর তিনি বাকহীন থেকে ১৯৭৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
কবির মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিএনপি’র চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।