নিজস্ব প্রতিবেদক,রবিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮:
রূপগঞ্জ উপজেলার শীতলক্ষ্মা নদীর ওপর নির্মিত কাঞ্চন সেতুর টোলের নির্ধারিত সময়সীমা পার হলেও বন্ধ হয়নি টোল আদায় প্রথা। নিয়ম বহির্ভূতভাবে ব্যস্ততম এ সেতুর টোল প্লাজা থেকে প্রতিদিন পরিবহনগুলো থেকে কমপক্ষে পনেরো-ষোল লাখ টাকার টোল আদায় করছে নারায়ণগঞ্জ সওজ বিভাগ।
সওজের দাবি, সরকারের সিদ্ধান্তেই টোল আদায় করা হয় সেতু থেকে। অনিয়ম, দুর্নীতি আর পুলিশসহ স্থানীয় সরকারদলীয় ব্যক্তিবর্গকে চাঁদা দিয়ে অব্যাহত রাখা হয়েছে টোল আদায় প্রথা। এরই মধ্যে টোল বুথের সামনের ব্যারিয়ার, যানবাহনের শ্রেণি অনুযায়ী নির্ধারিত ফি প্রদর্শন মেশিনগুলো অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে।
সওজ ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অসাধু ব্যক্তিবর্গের যোগসাজসে মাসিক হারে গোপন লেনদেন করে চলছে স্থানীয় রুটের ৫ শতাধিক পরিবহন। সেতু ও সেতুসংলগ্ন রাস্তাঘাট মেরামতে নেই যথাযথ উদ্যোগ। ব্যস্তবহুল ঢাকা-বাইপাস রুটে যানবাহনের বাড়তি চাপ আর টোল আদায়ে ধীরগতির কারণে সৃষ্টি হচ্ছে তীব্র যানজট। এতে ভোগান্তিতে পড়ছেন পণ্যবাহী পরিবহনের চালকসহ যাত্রী সাধারণ।
জানা যায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জের মদনপুর থেকে গাজীপুর জেলার জয়দেবপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত ঢাকা-বাইপাস সড়ক নামে ৪৮ কিলোমিটার রাস্তাকে কাঞ্চন সেতুর মাধ্যমে যুক্ত করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর ও সিলেটের সঙ্গে দেশের উত্তরাঞ্চলের সরাসরি সংযোগ স্থাপনের জন্য সেতুটি নির্মাণ করা হয়। ২০০৬ সালের অক্টোবরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সেতুটি উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনের সময় ১০ বছর পর্যন্ত টোল আদায় করার কথা বলা হয়েছিল বলে সওজের একটি সূত্র থেকে জানা গেছে। সে অনুযায়ী ২০১৬ সালে টোল আদায়ের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও টোল আদায় এখনও চলছে।
উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে উদ্বোধনকালীন সময় থেকে বর্তমানে এ রুটে যান চলাচল বৃদ্ধি পেয়েছে ২৫ গুণ। দিনে অন্তত ১৫/১৬ হাজার যানবাহন এ রুটে চলাচল করে বলে জানা যায়।
এরমধ্যে হাইট্রলি, বড় ট্রেইলর, কাভার্ডভ্যান আর ট্রাকের সংখ্যায় সর্বাধিক। শীতলক্ষ্মা নদীর ওপর রাজধানী ঢাকায় প্রবেশের জন্য চারটি সেতু নির্মাণ করা হয়ছে। এরমধ্যে কাঁচপুর সেতু, ডেমরা-তারাব সেতু, মুড়াপাড়া-ইছাখালী সেতু ও কাঞ্চন সেতু রয়েছে। এসব সেতুর মধ্যে শুধু কাঞ্চন সেতুতেই মেয়াদ উত্তীর্ণ্যের পরও টোল আদায় করা হচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৯ সালের অক্টোবরে সড়ক ও জনপথ থেকে উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে তিন বছরের জন্য টোল আদায়ের ইজারা পায় মেসার্স এসইএল-ইউডিসি-জেভি নামক যৌথ মালিকানার একটি প্রতিষ্ঠান।
চুক্তি অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটিকে ওই সময়ে প্রতি মাসে গড়ে ৭ লাখ ৩৫ হাজার ৭০৭ টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে। বিপরীতে গড়ে প্রতিদিন টোল আদায় হয় পনেরো-ষোল লাখ টাকা। ২০১২ সালের অক্টোবরে প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার নড়াইলের বাসিন্দা আবুল কালাম সরকার অনেকটা অগোচরেই কুবেরের এই টাঁকশালের দখলদারিত্ব নিতে আরো ৫ বছরের জন্য টোল আদায় ইজারা নিজের করে নেন।
সে অনুযায়ী গত বছরের অক্টোবরে তাদের সে মেয়াদকালও শেষ হয়ে গেছে। এরপর নারায়ণগঞ্জ সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তর ৩ মাসের জন্য আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে পরবর্তীতে আরো ছয় মাসের জন্য একই প্রতিষ্ঠানকে টোল আদায়ের দায়িত্ব দেয়।
সে চুক্তিও শেষ হয়ে গেছে চলতি জুন মাসে। অবাক করার বিষয়, গত দুই মাসেরও অধিক সময় নারায়ণগঞ্জ সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তর টোল আদায়ের দায়িত্বে থাকলেও অজ্ঞাত শক্তির বলে টোল আদায় করছেন সেই প্রভাবশালী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স এসইএল-ইউডিসি-জেভি।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, ব্যাপক হারে অনিয়ম হচ্ছে কাঞ্চন টোল প্লাজায়। অনিয়ম, দুর্নীতি আর পুলিশসহ স্থানীয় সরকারদলীয় ব্যক্তিবর্গকে চাঁদা দিয়ে অব্যাহত রাখা হয়েছে টোল আদায় প্রথা। মাসিকহারে প্রকল্প পরিচালক কারিবুল ইসলামের কাছ থেকে রূপগঞ্জ থানা পুলিশ, ভোলাব ফাঁড়ি পুলিশ, স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ আর মহিলা লীগের নামে যাচ্ছে খাম। এরই মধ্যে টোল বুথের সামনের ব্যারিয়ারগুলো নষ্ট হয়ে গেছে।
বাঁশ দিয়ে আটকে রাখা হয় যানবাহন। গত মার্চে একটি ট্রাক টোল ফাঁকি দিতে বাঁশের ব্যারিকেট ভেঙে পালানোর সময় দুই পথচারীকে চাকায় পিষ্ট করেন। এছাড়া টোল ফাঁকি দেয়ায় চেষ্টায় পরিবহন চালকরা প্রায়শ ঘটাচ্ছেন দুর্ঘটনা। এতে বহু প্রাণহানীর ঘটনার নজির রয়েছে।
যানবাহনের শ্রেণি অনুযায়ী নির্ধারিত ফি প্রদর্শন মেশিনগুলো অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে। সওজ ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অসাধু ব্যক্তিবর্গের যোগসাজসে মাসিক হারে গোপন লেনদেন করে স্থানীয় রুটের ৫ শতাধিক ট্যাক্সি, লেগুনা, বটবটি, ট্রাক্টর চলাচল করছে।
সেতু ও সেতু সংলগ্ন রাস্তাঘাটগুলোর বেহাল দশা। মেরামতে নেই যথাযথ উদ্যোগ। ব্যস্তবহুল ঢাকা-বাইপাস রুটে যানবাহনের বাড়তি চাপ আর টোল আদায়ে ধীরগতির কারণে প্রতিদিন সৃষ্টি হচ্ছে তীব্র যানজট। এতে ভোগান্তিতে পড়ছেন পণ্যবাহী পরিবহন চালকসহ যাত্রী সাধারণ।
সড়ক ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের হিসাব অনুসারে প্রতিদিন ১০-১২ হাজার গাড়ি পারাপার হয় কাঞ্চন সেতু দিয়ে। তাদের মতে, ১১ থেকে ১২ লাখ টাকার টোল আদায় হয় দৈনিক। অনুসন্ধান বলছে ভিন্ন কথা। প্রতিদিন অন্তত ১৫-১৬ হাজার যানবাহন এ রুটে চলাচল করে বলে জানা যায়।
এরমধ্যে হাইট্রলি, বড় ট্রেইলর, কাভার্ডভ্যান আর ট্রাকের সংখ্যায় সর্বাধিক। দিনে অন্তত পনেরো-ষোল লাখ টাকার টোল আদায় হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে। কম্পিউটারে প্রিন্টিং করা একটা রশিদ পরিবহন চালকদের দেয়া হলেও আদায়কৃত অর্থের হিসাবে আকাশ পাতাল গড়মিল রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
কাঞ্চন ট্রাফিক পুলিশ বক্সের ইনচার্জ ইন্সপেক্টর ইকবাল হোসেন বলেন, প্রায় সময়ই কাঞ্চন সেতু এলাকা থেকে যানজট সৃষ্টি হয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করে। যা নিয়ন্ত্রণ করতে পুলিশকে হিমশিম খেতে হয়।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স এসইএল-ইউডিসি-জেভির পক্ষে টোলপ্লাজায় দায়িত্বরত প্রকল্প পরিচালক কারিবুল ইসলাম প্রভাবশালীদের চাঁদা প্রদানের বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বলেই আমরা কাজে নিয়োজিত আছি। সরকার যখন আমাদের আর দেবেন না আমরাও আর করবো না।
টোল আদায়ের মেয়াদকাল শেষ হয়েছে কি না সেটা আমার জানা নেই।
এ ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জ সড়ক ও জনপদ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মুহা. আলিউল হোসেন বলেন, দশ বছর টোল আদায়ের পর আর টোল আদায় না করার কথা সঠিক নয়। এমন কোনো চুক্তি কোথাও নেই। সরকারের সিদ্ধান্তেই টোল আদায় করা হচ্ছে।
সরকার নির্ধারিত টোলের বাইরে বাড়তি টোল নেয়ার কোনো সুযোগ নেই সুতরাং কাউকে চাঁদা দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। টোল বুথের ব্যারিয়ার যানবাহনের ধাক্কায় মাঝে মধ্যে ভেঙে যায়। এগুলো আবার ঠিক করা হয়। কম্পিউটারে এন্ট্রি ছাড়া টোল আদায়ও করা হয় না।
তিনি আরো বলেন, এই সড়কটি পিপিএস-এর আওতায় পাবলিক-প্রাইভেট অংশীদারিত্বে চার লেনে উন্নীত করার কাজের প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। সেটি শুরু হলে টোল আদায়সহ পুরো ৪৮ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে দেয়া হবে। পুরো সড়কটি টোল রোড হবে কাজ শেষ হওয়ার পর ২৫ বছরের জন্য।