খন্দকার শাহিন,বুধবার:
আজ ১২ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সনের এইদিনে নরসিংদী পাকহানাদার মুক্ত হয়। মাতৃভূমিরর জন্য জীবন বাজি রেখে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে নরসিংদীসহ প্রিয় মাতৃভূমিকে মুক্ত করতে পারলেও জীবন যুদ্ধে আজও মুক্ত হতে পারেননি মুক্তিযোদ্ধা রবীন্দ্র চন্দ্র সাহা। তাই স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও দুমুঠো ডাল-ভাতের জন্য জীবন যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধের এই বীর সেনানী। দুই ছেলে এক মেয়ে ও নাতি ননাতনীসহ ১০ সদস্যের পরিবারে খাবারের যোগান দিতে পথেপথে আচাঁড় আর জাল মুড়ি বিক্রিই তার ভরসা। ব্যস্ত শহর মাধবদীর গরুর হাটে প্রতি সোমবার আচাঁড় আর জাল মুড়ি বিক্রির পসরা সাজিয়ে বসেন তিনি। এছাড়া হাটের দিন ব্যতিত তিনি এসব বিক্রি করেন মেলা, পূজা কিংবা মাহফিলে। এতে যা আয় হয় তাতেই অতি কষ্টে সংসার চলে মুক্তিযুদ্ধা রবীন্দ্র চন্দ্র সাহার। রবীন্দ্র চন্দ্র সাহা (৭০) স্বর্গীয় যোগেশ চন্দ্র সাহার ছেলে। তিনি মাধবদী পৌরসভার ফুলতলা মহল্লার স্থায়ী বাসিন্দা। দুই ছেলে এক মেয়ে ও নায় নাতিসহ ১০ সদস্যের পরিবার নিয়ে সহায় সম্বলহীন ভাবে জীবনযাপন করছেন তিনি।
এই কনকনে শীতের রাতে মাধবদীর গনেরগাঁও নামকস্থানে এক ওয়াজ মাহফিলে আলাপ হয় ১৯৭১ এর এই মুক্তিযোদ্ধার সাথে। আলাপচারিতার চুম্বক অংশ নীচে তুলে ধরা হলো:
আপনি মুক্তিযুদ্ধে অংশে নেন কিভাবে?
তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে হঠাৎ জানতে পারলাম দেশে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। বাঙ্গালীদের হত্যার জন্য পাক বাহিনী মরিয়া হয়ে উঠেছে। প্রিয় মাতভূমিকে পাক হানাদার মুক্ত করার জন্য মায়ের কোল ছেড়ে সহপাঠীদের সাথে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য বাড়ী থেকে পালিয়ে যান তিনি। তারপর পায়ে হেটে কুমিল্লার সালদা নদী হয়ে ভারতের আগরতলা গিয়ে তিনি প্রশিক্ষণ নেন। ২০/২৫ দিন প্রশিক্ষণ শেষে আগরতলায় আটকা পরেন মুক্তিযোদ্ধা রবীন্দ্র চন্দ্র সাহাসহ অনেক মুক্তিবাহিনী। প্রায় দেড় মাস জীবনের সাথে পাঞ্জা লড়ে সহযোদ্ধাদের সাথে নরসিংদীতে আসেন তিনি। পরে ৭০/৮০ জনের মুক্তিবাহিনীর সাথে নরসিংদীতে পাকবাহিনীর ক্যাম্প ধ্বংস করার জন্য পাঁচদোনায় গোপন আস্তানা তৈরী করেন। এ আস্তানায় ১৭ জন করে চারটি গ্রুপ করা হয়। তার মাঝে রবীন্দ্র চন্দ্র সাহার গ্রুপের নেতৃত্ব দেন মাধবদীর মনির হোসেন ও মোতালিব পাঠান। মুক্তিযোদ্ধা রবীন্দ্র চন্দ্র সাহার গ্রুপ প্রতিদিনই পাঁচদোনা এলাকায় মহাসড়কে ওঁৎ পেতে থাকেন পাকবাহিনীর ধ্বংস করার জন্য।
১৯৭১ যুদ্ধ সম্পর্কে আরো কিছু বলেন?
তিনি বলেন, নরসিংদীকে ৩ নম্বর সেক্টরের অধীন করা হয়, তার কমান্ডার ছিলেন ব্রিগেডিয়ার মোঃ নূরুজ্জামান। সারাদেশে যুদ্ধ চলাকালীন নরসিংদীতে ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে পাক হানাদার বাহিনী বিমান থেকে বোমা বর্ষণ করে। এতে নরসিংদীর বিভিন্ন গ্রাম পুড়ে যায়। এ সময়ে পাক বিমান বাহিনীর গোলা বর্ষণে শহীদ হন আবদুল হক, নারায়ণ চন্দ্র সাহা, আব্দুল্লাহসহ ১২/১৩জন।
কোন যুদ্ধ অপরাধী সম্পর্কে বলেন?
তিনি আরো জানান, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কুখ্যাত রাজাকার আব্দুর রশীদের সহযোগিতায় ১৬ অক্টোবর পাক হানাদার বাহিনী মাধবদীর আলগী গ্রামে তারিনী ভূইয়া বাড়িতে অতর্কিত হামলা চালিয়ে সেখানে অবস্থানরত ৬ মুক্তিযোদ্ধাকে গুলি করে ও বেয়নেটের আঘাতে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এখানে শহীদ হন মুক্তিযোদ্ধা তাইজ উদ্দিন পাঠান, আনোয়ার হোসেন, সিরাজ মিয়া, আওলাদ হোসেন, মোহাম্মদ আলী ও আঃ সালাম।
নরসিংদী কিভাবে হানাদার মুক্তহলো?
স্বাধীনতা যুদ্ধের দীর্ঘ ৯ মাসে নরসিংদী জেলার বিভিন্ন স্থানে শতাধিক খন্ডযুদ্ধ সংঘটিত হয়। পরে মুক্তিযোদ্ধা নেভাল সিরাজ, মনির হোসেন, আব্দুল মোতালিব পাঠানসহ অন্য মুক্তিযোদ্ধারা মাধবদীর থানার বালাপুর, আলগী ও ধর্মপুরের ক্যাম্প থেকে একযোগে পাক হানাদার বাহিনীর অবস্থান লক্ষ্য করে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করলে তাদের সাথে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সৈন্যরাও যোগ দেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর কমান্ডার জেনারেল নাগরার নেতৃত্বে হেলিকপ্টারে মাধবদী থানার বালুশাইর এলাকায় ভারতীয় সৈন্যরা এসে অবস্থান নেন। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। এ অবস্থায় পাকবাহিনী বিনা যুদ্ধেই পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের তীবৃ আক্রমণের মুখে এভাবেই হানাদার বাহিনী পিছু হটতে থাকে। চুড়ান্ত পর্যায়ে ১২ ডিসেম্বর নরসিংদী পাক হানাদার মুক্ত হয়। কিন্তু জীবন যুদ্ধে মুক্ত হয়নি মুক্তিযুদ্ধা রবীন্দ্র চন্দ্র সাহা।
আপনি মুক্তিযোদ্ধা হয়েও আচাঁড় আর ঝাল মুড়ি বিক্রি করেন কেন?
এসময় তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হলে আজ আমার এতো কষ্ট করতে হতো না। অভাবের সংসার আমার, ভাতার টাকায় চলে না, ছেলে পোলাদের মানুষ করতে আজ ২০ বছর ধরে এ পেশায় জড়িত। বড় ছেলেকে প্রাইমারী পর্যন্ত লেখা পড়া করাতে পারছি। মেয়েকে অষ্টম শ্রেণী ও ছোট ছেলেকে এসএসসি পরিক্ষা দেয়াতে পারছি। কিন্তু কেউই সংসারের হাল ধরতে না পারায় ৭০ বছর বয়সেও তার দিনেও রাতে ঠুকনি কাঁধে নিয়ে পায়ে হেটে আচাঁড় আর ঝাল মুড়ি বিক্রি করতে হচ্ছে বলে তিনি জানান।আজ আমার মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি আছে, নাই সহায় সম্বল। অর্থের অভাবে সন্তানদের লাইনে নিতে পারছি না। তিনি আরো বলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষ সহযোগিতা করে থাকে । তার জীবনযুদ্ধেও সহযোগীতার জন্য তিনি বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি বিনীত অনুরোধ জানান।