নিউজ ডেস্ক | বৃহস্পতিবার,৩১ জানুয়ারি ২০১৯:
বিভিন্ন সময় মেয়াদ শেষে যথারীতি শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের প্রতিনিধি নির্বাচন হলেও দীর্ঘ ২৬ বছর ধরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) ছাত্র সংসদ ‘জাকসু’ নির্বাচন দেয়া হচ্ছে না। আর তাতে অকার্যকর হয়ে পড়ছে জাকসু। এবার জাকসু নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে নামছে জাবি শিক্ষার্থীরা।
সর্বশেষ গত ২৭ জানুয়ারি উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হলো ৩য় শ্রেণি কর্মচারীদের সংগঠন ‘কর্মচারী সমিতি’ ও ৪র্থ শ্রেণি কর্মচারীদের সংগঠন ‘কর্মচারী ইউনিয়ন’র নির্বাচন।
এছাড়া আগামী ৩১ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ‘শিক্ষক সমিতি’র নির্বাচন। অন্যদিকে অফিসার সমিতির নির্বাচনেরও কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
এসব নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের তাদের সমস্যা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সাথে দেন-দরবার এমনকি দাবি আদায়ে আন্দোলনও করতে দেখা যায়।
সর্বশেষ শিক্ষকদের বাড়ি ভাড়া ভাতা ১৫% কমানোর প্রতিবাদে আদালতে রিট করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘শিক্ষক সমিতি’। এইভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীরা প্রতিনিধি নির্বাচন করে তাদের দাবি দাওয়া আদায়ে পদক্ষেপ নিতে পারলেও শিক্ষার্থীদের সমস্যা নিয়ে কথা বলার কেউ নেই।
কারণ গত ২৬ বছর ধরে বন্ধ আছে শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি নির্বাচন ‘জাকসু’। বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থীরা ‘জাকসু’ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করলেও তাতে কর্ণপাত করেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
তবে ভিসি অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের সময় ‘জাকসু’ সচলের উদ্যেগ নেওয়া হলেও তা সফলতার মুখ দেখেনি। বর্তমান ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলামও বার বার ‘জাকসু’ কার্যকর করার আশ্বাস দিয়েই যাচ্ছেন। কিন্তু কোন আশ্বাসই সফলতার মুখ দেখেনি।
তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বে ঘোষণা দিয়েছিলেন- ‘আবারও জাবির ভিসি হিসেবে দায়িত্বে আসলে ‘জাকসু’ কার্যকর করবেন।’ এছাড়া দীর্ঘ ২২ বছর পর অনুষ্ঠিত রেজিস্টার্ড গ্রাজুয়েট নির্বাচনের পূর্বেও তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, ‘সিনেট নির্বাচনের পরেই ‘জাকসু’ নির্বাচনের আয়োজন করবেন।’ এরপর একবছরের বেশি সময় পার হয়ে গেলেও এ বিষয়ে এখনও কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি।
সর্বশেষ তিনি জাকসুর বিষয়ে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে আবারও নতুন আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘ শিক্ষার্থীরা চাইলে আগামী বছর ‘জাকসু’ নির্বাচন করা সম্ভব হবে। কারণ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরপর বিভিন্ন নির্বাচন। এরপর মেগা প্রজেক্টটা শুরু করব। তারপর জাকসু ইলেকশনটা করব। তবে আগামী জানুয়ারি কিংবা ফেব্রুয়ারির আগে সম্ভব না।’
তবে তিনি আরও বলেছেন, ‘আমার প্রথম থেকে আশা ছিল জাকসু নির্বাচন দিব। কারণ ছাত্র সংসদ ছাড়া বিবিধ নেতৃত্বের বিকাশ হয় না। আমি আগেও বলেছিলাম সিনেট ইলেকশনের পর জাকসু নির্বাচন দিবো কিন্তু সিনেট ইলেকশনের পরের অবস্থা দুঃখজনক পর্যায়ে গেছে। সিনেট ইলেকশনের পর বিভিন্ন বাঁধা পাচ্ছি এমনকি আইনগত বাঁধাও পাচ্ছি। এমনঅবস্থায় আমরা যদি জাকসুর আয়োজন করি সেক্ষেত্রে আমরা কিভাবে ভোটার এবং প্রার্থী তৈরি করবো সেটা আমাদের চিন্তা করতে হবে।’
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্নপন্থি শিক্ষকরাও নিজেদের প্রয়োজনমত ‘জাকসু’র দাবি তুলে সরব হন। আবার প্রয়োজন শেষ হয়ে গেলে দাবিটি নিয়ে আর কথা বলেন না।
এমন অবস্থায় ‘ডাকসু’ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর ‘জাকসু’র দাবিতেও আবারও সরব হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনসহ সব রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ জাকসু নির্বাচনের বিষয়ে একমত হয়েছেন। তারা সবাই ‘জাকসু’ নির্বাচন চান। এই বিষয়ে তারা প্রশাসনকে যে কোন ভাবে সহযোগীতা করতে প্রস্তুত আছেন বলে জানিয়েছেন।
কিন্তু প্রশাসনের জাকসু নির্বাচন আয়োজনে কোন উদ্যেগ দেখা না যাওয়ায় তারা চূড়ান্ত আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এমন আবাস দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
তারা জানিয়েছেন, ‘আমরা প্রথমে প্রশাসনের সাথে জাকসু নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করবো। যদি প্রশাসন তাতে রাজি হয়ে তফসিল ঘোষণা করে, তাহলেতো খুব ভাল। আর যদি না হয় তাহলে আন্দোলনের মাধ্যমেই জাকসু নির্বাচন আদায় করে নিতে হবে। ’
জাকসু না থাকায় যেসব সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা:
‘জাকসু’র গঠনতন্ত্রে উল্লেখ আছে ‘জাকসু’র লক্ষ্য হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্য সাংস্কৃতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিগত সহযোগিতা বাড়ানো, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সর্বাধিক পরিমাণে লেখাপড়া এবং এর বাইরের সুযোগ সুবিধা অর্জন করা, প্রকৃত নাগরিক রূপে ছাত্রদের গড়ে তোলা এবং তাদের মধ্য নেতৃত্বের উন্মেষ ঘটানো।’ এছাড়া ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশের ১৯ (২) ধারায় বলা আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্যানেল নির্বাচনে জাকসু থেকে পাঁচজন নির্বাচিত প্রতিনিধির ভোটাধিকার আছে। কিন্তু গত ২৬ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘জাকসু’র কার্যক্রমের অনুপস্থিতে ছাত্রসংশ্লিষ্ট এসব কার্যক্রম স্তিমিত হয়ে পড়ছে। এ দিকে ‘জাকসু’ কার্যকর না থাকায় এবং প্রশাসনের অবহেলায় ‘জাকসু’ ভবনের অবস্থা ভয়াবহ। অধিকাংশ সময় ভবনটিতে মাদক সেবনের আখড়া বসতে দেখা যায়। তবে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের পাঠস্থান হিসেবেও ভবনটি ব্যবহার করা হয়।
জাকসু নিয়ে যা ভাবছে ছাত্রসংগঠন ও শিক্ষক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ:
বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের একাংশের সংগঠন ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজ’র সাধারণ সম্পাদক সহযোগী অধ্যাপক ফরিদ আহমেদ বলেছেন, ‘জাকসু নির্বাচন করার ব্যাপারে প্রশাসনের আগ্রহের ঘাটতি রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বমহল থেকে বার বার এই বিষয়ে দাবি উঠেছে। কিন্তু তারপরও প্রশাসনকে কোন ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। তাই আমরা মনে করি প্রশাসন আগ্রহ প্রকাশ করলেই জাকসু নির্বাচন করা সম্ভব।’
এ ব্যাপারে জিয়া পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আহ্বায়ক অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল আহসান বলেন, ‘প্রশাসনের সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া উচিৎ। সকল ছাত্রের সহ অবস্থান নিশ্চিত করা উচিৎ এবং ছাত্রসংগঠনগুলোর সঙ্গে আলোচনার প্রেক্ষিতে তাদের চাহিদা অনুযায়ি জাকসু নির্বাচনের আয়োজন করলেই তাহলে কেবল লক্ষে পৌঁছা সম্ভব হবে।
জাকসু নির্বাচনের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন প্রসঙ্গে জাবি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. জুয়েল রানা ব্রেকিংনিউজকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট যে কোনও আন্দোলনে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ সবসময় পাশে ছিল এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীর প্রাণের দাবি ‘জাকসু’ নির্বাচন আমরাও চাই। অতিদ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিকট জাকসু নির্বাচনের আয়োজনের জোর দাবি জানাচ্ছি। জাকসু নির্বাচন আয়োজনে যে কোনও ধরনের সহায়তা করতেও আমরা সর্বোচ্চ প্রস্তুত আছি।’
জাবি ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহিম সৈকত বলেন, ‘জাকসু নির্বাচন আয়োজন করার পূর্বে অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সকল ছাত্রের সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হবে।’
গত মঙ্গলবার জাবি ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে আগামী তিন মাসের মধ্যে জাকসু নির্বাচনের দাবি জানানো হয়েছে। বিবৃতিতে ৪ দফা দাবি জানিয়ে বলা হয়েছে, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের পূর্ণাঙ্গ পরিবেশ বিরাজ করছে। ডাকসু নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর সর্বস্তরের শিক্ষার্থীরাও এই মুহূর্তে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার দাবিতে অতিতের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি মাত্রায় সেচ্চার। বিশ্ববিদ্যালয়ের আভ্যন্তরীন পরিস্থিতিও অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে স্থিতিশীল ও ছাত্র সংসদ নির্বাচনের অনুকূলে। তাই আগামী ৩ মাসের মধ্যে জাকসু নির্বাচনের জোড় দাবি জানাচ্ছি।
এদিকে বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সমিতির নির্বাচন চলার সময় জাকসু নির্বাচনের দাবিতে মানববন্ধন করেছে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট। অন্যদিকে তারই পাশে একই দাবিতে শিক্ষকদের কাছ থেকে স্বাক্ষর ও মন্তব্য সংগ্রহ করেছেন ছাত্র ইউনিয়ন জাবি সংসদ।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট (মাকর্সবাদী) জাকসু নির্বাচনের দাবিতে গতকাল বুধবার সংবাদ সম্মলন করে আগামী ৪ ফেব্রুয়ারি সংহতি সমাবেশ ও পরবর্তীতে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে।
জাকসু নির্বাচন বন্ধ হলো যেভাবে:
১৯৭১ সালের ১২ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। প্রতিষ্ঠার পর ১৯৭২ সালেই গঠিত হয় জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি সেন্ট্রাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (জাকসু)। একই বছর প্রথম জাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যার ভিপি নির্বাচিত হন গোলাম মোর্শেদ এবং জিএস রোকন উদ্দিন। এরপর ৭৪, ৭৯, ৮০, ৮১, ৮৯, ৯০, ৯১ ও ৯২ সালসহ ৯ বার জাকসু নির্বাচন হয়।
সর্বশেষ ১৯৯২ সালের নির্বাচনে ভিপি নির্বাচিত হন মাসুম হাসান তালুকদার লিটন এবং জি এস নির্বাচিত হন শামসুল তাবরিজ। এরপর এক ছাত্রের বহিষ্কারকে কেন্দ্র করে ১৯৯৩ সালের ২৯ জুলাই ছাত্র ও শিক্ষকদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ বাঁধলে তৎকালীন প্রশাসন জাকসু ও হল সংসদ বাতিল করে। এরপর ২৬ বছর পার হলেও আর জাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি।
খবর: ব্রেকিংনিউজ.বিডি.কম