নিউজ ডেস্ক | মঙ্গলবার,২৮ মে ২০১৯:
প্রায় দুই কোটি নাগরিকের মেগাসিটি ঢাকা। এখানকার বেশির ভাগ মানুষের শিকড় এখনো গ্রামের সঙ্গে পোঁতা। ঈদ এলেই এর প্রমাণ মেলে। পরিবার-পরিজনের সঙ্গে উৎসবের আনন্দ ভাগাভাগি করতে নগরবাসী ছোটেন নিজ নিজ জন্মভূমিতে। সঠিক কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও প্রতি বছর ঈদে ৮০ লাখের বেশি মানুষ ঢাকা ছাড়েন। মাত্র তিন-চারদিনের ছুটিতে একযোগে মানুষ ঢাকা ছাড়ায় সড়কপথে সৃষ্টি হয় দীর্ঘ যানজট। আবহাওয়া প্রতিকূলে থাকলে যানবাহনের ধীরগতি ও জট আরও বেড়ে যায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা ও রীতিমতো সংগ্রামের পর পৌঁছনো যায় গন্তব্যে। শুধু বাস নয় ট্রেন, লঞ্চ এমনকি আকাশপথেও জট সৃষ্টি হয়। ঈদে ঘুরমুখো মানুষের সীমাহীন দুুর্ভোগ তাই ফি বছরের নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুদ্ধ করে টিকিট পাওয়ার পর এবারের ঈদযাত্রা কেমন হতে পারে এ নিয়ে টেনশন এখন সবার মাঝেই।
এবারে ঈদের আগে সড়কে বেশকিছু সুখবর এসেছে। বিশেষ করে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে (দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল) খুলে দেওয়া হয়েছে দ্বিতীয় মেঘনা, দ্বিতীয় গোমতী ও দ্বিতীয় কাঁচপুর সেতু। এর সুফল মিলেছে হাতেনাতে। ঢাকা থেকে এখন কুমিল্লাতে মাত্র দেড় ঘণ্টাতেই যাওয়া যাচ্ছে। আগে দীর্ঘ যানজটের কারণে এ পথ পাড়ি দিতে কখনো কখনো ৮-১০ ঘণ্টাও লেগে যেত। এবার ঈদের আগে উত্তরবঙ্গের ২৩ জেলার বাসিন্দাদের জন্যও সুখবর এসেছে। কারণ এ মহাসড়কে জয়দেবপুর-চন্দ্রা-টাঙ্গাইল-এলেঙ্গা মহাসড়কে কোনাবাড়ী ও চন্দ্রা ফ্লাইওভার খুলে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া কালিয়াকৈর, দেওহাটা, মির্জাপুর ও ঘারিন্দা আন্ডারপাস এবং কড্ডা-১ সেতু ও বাইপাইল সেতুর উদ্বোধন করা হয়েছে। এরপর এ মহাসড়কের চিরচেনা চিত্র পাল্টে গেছে। তবে এ মহাসড়কে ঈদযাত্রায় যে ভোগান্তির শঙ্কা তা পুরোপুরি কাটেনি। বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও উত্তরবঙ্গগামী যাত্রীদের দুর্বিষহ ভোগান্তির কারণ হতে পারে টঙ্গীবাজার থেকে চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার মহাসড়ক। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু সেতুর টোলপ্লাজায় ধীরগতির টোল আদায় হলে সেখানেও ভোগান্তি পিছু ছাড়বে না।
ঢাকা থেকে পাটুরিয়া-দৌলতপুর ঘাট পার হয়ে যাদের দক্ষিণবঙ্গে যেতে হবে তাদের জন্য স্বস্তিকর কোনো সংবাদ নেই। যানবাহনের চাপে ফেরিতে যাত্রী পারাপারে দীর্ঘ সময় লেগে যাওয়ায় গত কয়েক বছরের মতো এবারও বাসের শিডিউল বিপর্যয়ের শঙ্কা রয়েছে। এক্ষেত্রে গন্তব্যে পৌঁছতে ৮-১০ ঘণ্টা বেশি সময় লেগে যেতে পারে।
এবারে ঈদযাত্রা শুরু হচ্ছে আগামী ৩০ মে থেকে। সম্ভাব্য ৫ জুন ঈদুল ফিতর ধরে নিয়ে বাসে বাড়ি যাওয়ার আগাম টিকিট কিনেছেন যাত্রীরা। সাপ্তাহিক ছুটি এবং শবেকদর ও ঈদের বন্ধ মিলিয়ে ছুটি দীর্ঘ হওয়ায় অনেকে আগেভাগেই বাড়ি যাচ্ছেন। ২ তারিখ শবেকদরের ছুটি। এরপর একদিন (৩ জুন) অফিস খোলা। ওই দিন তৈরি পোশাক কারখানায়ও ছুটি হচ্ছে। ফলে যানবাহনে মূল চাপটা শুরু হবে ৩ তারিখেই।
দেড় ঘণ্টাতেই কুমিল্লা
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে গত শনিবার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে মেঘনা ও গোমতী নদীর ওপর নির্মিত দ্বিতীয় মেঘনা ও দ্বিতীয় গোমতী সেতু এবং দ্বিতীয় কাঁচপুর সেতু উদ্বোধন করেন। এরই সুফলে ৩০ কিলোমিটারের যানজটময় পথ পাড়ি দেওয়া যাচ্ছে ৩০ মিনিটে। নতুন দুটি চার লেনের সেতু চালু হওয়ায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে মানুষের যাত্রা আরামদায়ক হয়েছে। ঈদে ঘরমুখো মানুষও এর সুফল পাবেন।
এত দিন চার লেনের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের যানবাহনগুলো দুই লেনের গোমতী ও মেঘনা সেতুতে ওঠার পর সেতুর দুই পাশে যানজটের সৃষ্টি হতো। বিশেষ করে শুক্রবার ও শনিবার, ছুটির দিন, ঈদসহ বিভিন্ন উৎসবের সময় যানজট ভয়াবহ আকার ধারণ করত। এর ফলে ভোগান্তি পোহাতে হতো চালক ও যাত্রীদের। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থেকে রোগী, নারী-শিশুসহ সব যাত্রীকে চরম ভোগান্তি পোহাতে হতো। তিনটি সেতু খুলে দেওয়ায় এখন ঢাকা থেকে কুমিল্লা যেতে দেড় ঘণ্টা সময় লাগছে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম যাওয়া যাচ্ছে সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টায়। এ পথে এবারের ঈদযাত্রায় স্বস্তিদায়ক হবে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
টঙ্গী-চান্দনা শঙ্কার ১৩ কিলোমিটার
ঘরমুখো মানুষের স্বস্তিদায়ক ঈদযাত্রায় ইতোমধ্যে সুবাতাস বইছে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের ভোগড়া বাইপাস থেকে চন্দ্রা পর্যন্ত। এই অংশে সাসেক প্রকল্প-১ এর অধীন কোনাবাড়ী ও চন্দ্রা এলাকায় দুটি নবনির্মিত ফ্লাইওভার দিয়ে যান চলাচল শুরু হয়েছে। এতে গাজীপুর মহানগরীর কোনাবাড়ী থেকে কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রা পর্যন্ত নিত্যদিনের যানজটের কবল থেকে রক্ষা পেয়েছেন যাত্রীরা। তবে এখনো যানজটের শঙ্কা কাটেনি ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গীবাজার বাসস্ট্যান্ড থেকে চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত। এই ১৩ কিলোমিটারের গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কটিতে বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের কাজ চলেছে। মহাসড়কের এই অংশটিতে কোথাও ফ্লাইওভার কোথাও আবার ড্রেননির্মাণ কাজ চলছে। কচ্ছপ গতির এ প্রকল্পের কাজের ফলে মহাসড়কটির বিভিন্ন স্থানে খানাখন্দ দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া সড়কের পিচ ফুলেফেঁপে উঠেছে বিভিন্ন স্থানে। মহাসড়কও সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। এতে স্বাভাবিকভাবে যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে।
বৃহত্তর ময়মনসিংহ ছাড়াও উত্তরবঙ্গের ২৩ জেলার ১১৮টি রুটের পরিবহন চলাচল করে গাজীপুরের ওপর দিয়ে। এ কারণে ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে প্রতি বছর ঈদযাত্রায় ঘরমুখো মানুষের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায় গাজীপুরের যানজট। তবে পরিবহন জট নিরসনে ‘ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের কোনাবাড়ী ও চন্দ্রায় দুটি ফ্লাইওভার নির্মিত হয়েছে। এতে যাত্রী দুর্ভোগ কমেছে। অথচ ঢাকা থেকে গাজীপুরের টঙ্গী হয়ে ভোগড়া বাইপাস পর্যন্ত প্রায় ১২ কিলোমিটার পথ। এই পথ অতিক্রম করেই কোনাবাড়ী ও চন্দ্রা। ফলে এই ১২ কিলোমিটার অংশে যানজটের সৃষ্টি হলে এর প্রভাব পড়তে পারে ঢাকার মহাখালী পর্যন্ত- এমন আশঙ্কা যাত্রী ও চালকদের।’
সরেজমিন দেখা গেছে, ঢাকা বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত ২০ দশমিক এক কিলোমিটারের বিআরটি প্রকল্পের কাজ চলছে। তবে টঙ্গী থেকে গাজীপুর চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত বিভিন্ন অংশে সড়কে নির্মাণসামগ্রী ফেলে রাখা হয়েছে। চান্দনা চৌরাস্তা থেকে টঙ্গী পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে কাঁচা ড্রেন নির্মিত হয়েছে। কোথাও আবার ড্রেন নির্মাণ কাজের জন্য ড্রেনের পানি মহাসড়ক ‘ছুঁই ছুঁই করছে।’ এমনিতেই মহাসড়কের দুপাশে জমে থাকা পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই। এর ওপর ঈদের ছুটিতে টানা বর্ষণ হলে মহাসড়কে জলাবদ্ধতা দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া এ প্রকল্পে ব্যবহৃত গাড়ি পার্কিং করে রাখা হচ্ছে টঙ্গী থেকে জয়দেবপুরের শিববাড়ী পর্যন্ত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ট্রাফিক পয়েন্টে।
সবার নজর বঙ্গবন্ধু সেতুর টোল প্লাজায়
প্রতি ঈদেই ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে যানজটে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয় ঘরমুখো মানুষের। তবে এবার আসন্ন রমজানের ঈদে মহাসড়কে যান চলাচল অনেকটা স্বস্তির হবে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ মহাসড়কে গাজীপুরের ভোগড়া থেকে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা পর্যন্ত প্রায় ৭০ কিলোমিটার ফোরলেন কাজের প্রায় ৯০ ভাগ সমাপ্ত হয়েছে। এ ছাড়া তিনটি আন্ডারপাসও উদ্বোধন হয়েছে। মহাসড়কের দুদিকে বর্ধিত কাজেরও প্রায় ৬০ ভাগ সমাপ্ত হয়েছে।
এত কিছুর পরও ঈদে যানজটের আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। কারণ মহাড়কের বিভিন্ন স্থানে যেমন রাবনা ফ্লাইওভার ও করটিয়া আন্ডারপাস মেরামতের কাজ চলছে। এ মেরামত কাজের জন্য এই অংশটুকুতে যানজটের আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়াও জামুর্কি বাজার এলাকা ও বাওইখোলা এলাকার প্রায় ৪০০ মিটার সড়কে ছোট ছোট গর্ত রয়েছে। যদিও আগামী দু’একদিনের মধ্যে এসব সমস্যা সমাধানে করা হবে বলে জানিয়েছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ।
চারলেন প্রকল্পের প্রকল্প ব্যবস্থাপক অমিত কুমার চক্রবর্তী জানান, মহাসড়কের বর্তমান যে চিত্র তাতে ঈদে যানজটের কোনো আশঙ্কা নেই বললেই চলে। ছোটখাটো যে সমস্যা রয়েছে তা দু’একদিনের মধ্যেই দূর করা হবে। বঙ্গবন্ধু সেতু-ঢাকা মহাসড়কে এবার ঈদে নির্বিঘ্নে যানবাহন চলাচল করবে বলেও আশা করেন তিনি।
এদিকে বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব প্রান্তে টোল প্লাজায় টোল আদায় যন্ত্রে কোনো রকম সমস্যার সৃষ্টি হলে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর যদি এ সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হয় তবে যানজট ৩০/৪০ কিলোমিটার পর্যন্তও দীর্ঘ হতে পারে। যানজট এড়াতে বঙ্গবন্ধু সেতুর পণ্যবাহী ট্রাকের ওজন স্কেলটি সচল রাখতে আগে থেকেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন অনেকে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু সেতু কর্তৃপক্ষের এক প্রকৌশলী জানান, বঙ্গবন্ধু সেতুর টোল প্লাজার সফটওয়্যার সিস্টেম সচল রাখতে সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। এই সিস্টেমে দায়িত্বরত প্রকৌশলীরা ২৪ ঘণ্টাই তাদের দায়িত্ব পালন করবে। সে কারণে সেতু পূর্বপ্রান্তে ঈদে যানজটের তেমন আশঙ্কা নেই বলেও জানান ওই প্রকৌশলী।
ঈদে ঘরমুখো মানুষের চলাচল নির্বিঘ্ন করতে এবং মহাসড়ক যানজটমুক্ত রাখতে টাঙ্গাইল জেলা পুলিশের পক্ষ থেকেও নেওয়া হয়েছে নানা পদক্ষেপ। টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার সঞ্জিত কুমার রায় জানান, মহাসড়ক যানজটমুক্ত রাখতে এবং যাত্রীদের নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে এবার ঈদে সাত শতাধিক পুলিশ মহাসড়কে নিয়োজিত থাকবে। পুলিশের ৪০টি ভ্রাম্যমাণ দল সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করবে।
-খবর: খোলা কাগজ-