গত ২৩ জুন হুমায়ুন কবির-তানজিনা পাটোয়ারী দম্পতিকে আটক করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগ। তারা অনলাইনে দুটি সাইট খুলে করোনার উপসর্গ রয়েছে এমন রোগীদের টার্গেট করে তাদের বাড়িতে গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করতেন। পরে কোথাও ফেলে দিতেন সেই নমুনা। এরপর বাসায় বসে সরকারি প্রতিষ্ঠানের আদলে হুবহু করোনার সার্টিফিকেট তৈরি করে ইচ্ছামতো পজিটিভ-নেগেটিভ বানিয়ে তা রোগীর ই-মেইলে পাঠাতেন। মনগড়া এই করোনার রিপোর্ট তৈরিতে জনপ্রতি ৫-৮ হাজার টাকা নিতেন। করোনা নিয়ে ভয়ঙ্কর এ প্রতারণায় জড়িত দম্পতির ই-মেইল যাচাই করে অন্তত ৪২ জনকে করোনার ভুয়া সার্টিফিকেট দেয়ার তথ্য পাওয়া যায়।
সাধারণত ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, গুগল, স্কাইপ- এ ভুয়া আইডি খুলে বিভিন্ন অনলাইন পোর্টাল ও ব্লগে মিথ্যা ও মানহানিকর তথ্য প্রচার, অশ্লীল ছবি ও ভিডিও আপলোড এবং মেসেজ পাঠিয়ে প্রতারণার ঘটনাগুলোই মোটা দাগে সাইবার অপরাধ হিসেবে পরিচিত। এসব অপরাধ দমনে সরকার সোচ্চার ও জোরালো কার্যক্রম শুরু করেছে। তবে এসব অভিযোগে বিচার ও সাজার হার খুবই কম। অনেকে তাই ক্ষতিগ্রস্ত হলেও লোকলজ্জা, ভয়-ভীতি বা হয়রানির শঙ্কায় অভিযোগও করেন না। স্বচ্ছ ধারণা না থাকা ও প্রতিকার পেতে বেশি সময় লাগায় অভিযোগে অনীহাও বেশি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ছাত্রী জানান, ফেসবুকে ফেক আইডি খুলে মেসেঞ্জারে প্রতিনিয়ত তাকে আপত্তিকর ছবি ও কুপ্রস্তাব দেয়া হচ্ছে। এদের বেশিরভাগ আইডিই মেয়েদের নামে। যদিও এসব আইডিগুলো ব্যবহার করে ছেলেরা।
তিনি বলেন, ‘মান সম্মানের ভয়ে এসব কথা না যায় বলা, না নেয়া যায় আইনি ব্যবস্থা। তাই বাধ্য হয়ে ফেসবুক ব্যবহারই বন্ধ করে দিতে হচ্ছে।’
বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া অন্য এক ছাত্র জানান, অজ্ঞাত ফেসবুক আইডির মাধ্যমে মেয়ে নাম দেয়া একজনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। এক পর্যায়ে গভীর সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। পরে কৌশলে তার আপত্তিকর ছবি নিয়ে মোটা অংকের টাকা দাবি করেন ওই ব্যক্তি। টাকা না দিলে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেন তিনি। পরে কোনো উপায় না পেয়ে ওই প্রতারকের দাবি করা টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে। তিনি বলেন, লোকলজ্জায় এসব বিষয়ে কাউকে বলা বা আইনি ব্যবস্থা নেয়া যায় না। কারণ, এতে নিজেরই মান- সম্মান নিয়ে টানা-হেচড়া হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকেই জানান, ফেসুবকে নানা নামে গ্রুপ খুলে সেখানে আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। আবার ছাত্রী-গৃহিণী থেকে শুরু করে নানা বয়সী মেয়েরা অর্থের জন্য অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ছেন। এদের মধ্যে আবার কেউ কেউ ছেলেদের প্রলোভন দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাইবার ক্রাইম নিয়ে কাজ করেন, এমন কর্মকর্তারা বলেন, ‘আমাদের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এখন যারা ফেসবুক ব্যবহার করে নানা ধরনের অপরাধ করেন, তাদের অধিকাংশ আইডি ভুয়া। আবার একটি গ্রুপ আছে, যারা দেশের বাইরে অবস্থান করেন। ফলে তাদের চিহ্নিত করা গেলেও আইনের আওতায় আনা অনেক সময় সম্ভব হয় না।
প্রাযুক্তি কাঠামো দুর্বল হওয়ায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অপরাধী ধরা পড়ছে না উল্লেখ করে সাইবার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একজন সাইবার অপরাধীকে নির্ণয় করতে গেলে ডিজিটাল সিগনেচার ও ইলেকট্রনিক আইডেন্টিটি প্রসেস সঠিক হতে হয়। অর্থাৎ প্রত্যেক পণ্যেরই সঠিক রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থা করতে হয়। কিন্তু এ বিষয়গুলোই এখনো সঠিক না হওয়ায় বিক্ষিপ্ত ঘটনা ছাড়া অপরাধীরা ধরা পড়ছে না।
তারা বলেন, দেশ ও মানবকল্যাণে আইসিটির ব্যবহার বাড়ছে। ফলে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রক্রিয়ায় অনেকটা অগ্রসর হওয়া গেছে। ইন্টারনেটের ব্যবহার যেন দেশ ও মানবকল্যাণে সীমাবদ্ধ থাকে, সেই বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে বলেও মন্তব্য করেন বিশেষজ্ঞরা।
পুলিশ সদর সদর দপ্তর বলছে, অপরাধের ধরন ও ধাঁচের ভিন্নতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পুলিশের সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। সাইবার অপরাধ মোকাবিলায় পুলিশের প্রতিটি ইউনিটে একটি করে সাইবার মনিটরিং সেল গঠন করা হয়েছে। এছাড়া পুলিশের সক্ষমতা বাড়াতে সর্বশেষ প্রযুক্তির সংযোজনসহ কর্মকর্তাদের বিদেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা হচ্ছে।
র্যাব সদর দপ্তরের কর্মকর্তারা বলেন, ‘এ ধরনের অভিযোগ পাই এবং তদন্ত করে ব্যবস্থা নিই। তবে অপরাধীদের চিহ্নিত করার পরও ভুক্তভোগী অনেকেই মামলা করতে চান না। তারা চান বিষয়টি মিটিয়ে ফেলতে। যা অনেক সময় অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স শাখার উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) ওয়ালিদ হোসেন সারাক্ষণকে বলেন, ‘যিনি প্রতারিত হন, তিনি অভিযোগে দিলে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়। পুলিশের কাছে অভিযোগ দিলেই সিরিয়াসলি দেখা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রতিকারও হয়। যারা প্রতারণার শিকার তাদের প্রতি বিশেষ অনুরোধ, তারা যেন পুলিশের নজরে নিয়ে আসেন।’ তার মতে, ‘প্রতারণা তো দুটি পক্ষের লোকের আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে হয়। আগেই বুঝে যাওয়ার মতো ক্ষমতা তো নেই। পুলিশকে জানানো হলে ব্যবস্থা নিতে পারবে। একটি বিষয় আছে, কিছু চক্র কাজ করে। প্রতারণা করে, এমন অনেক চক্রকেই পুলিশ আইনের আওতায় নিয়ে আসছে। আমি মনে করি, পুলিশ এটা দক্ষতার সঙ্গেই করছে। এক্ষেত্রে পুলিশকে ব্যর্থ বলার সুযোগ নেই।’
গ্রেপ্তারের পরও জামিনে বের হয়ে ফের প্রতারণা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘প্রতারণা প্রতিরোধের আইনটা আরো কঠোর হওয়া প্রয়োজন। আইনের ফাঁক দিয়ে তারা বেরিয়ে আসে।’
‘প্রতারণার হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে মানুষকে লোভ কমাতে হবে। সাধারণ মানুষের লোভের কারণে প্রতারকরা তাদের পেয়ে বসে। তাদের বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্নও হতে হবে। তাদের জানা থাকতে হবে, প্রতারকরা আশেপাশেই আছে। বিষয়টি মাথায় রেখে সতর্ক থাকতে হবে। অনেক সময় দেখা যায়, মোবাইলে মেসেজ আসে, আপনি ১০ কোটি টাকা পেয়েছেন। টাকা পেতে এটি প্রসেস করতে ২০ হাজার টাকা বিকাশ করেন। যিনি লোভে পরে টাকাটা পাঠিয়ে দিবেন, তিনি তো ক্ষতিগ্রস্ত হবেনই।’
ওয়ালিদ হোসেন বলেন, ‘ডিএমপিতে প্রতিদিনই প্রতারক ধরা পড়ছে। ফেসবুকসহ সামাজিক মাধ্যম আমাদের সাইবার এবং সিআইডির ক্রাইম ইউনিট কাজ করছে। আমরা আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করছি।’
অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের প্রধান অতিরিক্ত ডিআইজি রেজাউল হায়দার বলেন, ‘আমাদের এসব ক্ষেত্রে ঘাটতি নেই, ত্রুটিও নেই। সক্ষমতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘যখন আমরা বলবো, কোনোটা পারিনি, তখন বুঝতে হবে, সেখানে আমাদের সক্ষমতা নেই। আমাদের এখনকার যে ক্যাপাসিটি আছে, উন্নত বিশ্বে যে ধরনের টেকনোলজি আছে, আমরাও সে ধরনের টেকনোলজি ব্যবহার করছি। আমরা কোনো কিছু তৈরি করি না, আমরা কিনি। কেনার সময় সবচেয়ে উত্তমটাই আমরা কিনি। টেকনোলজিতে আমরা পিছিয়ে নেই।’
বাংলাদেশে সাইবার ক্রাইম নিয়ন্ত্রণে কাজ করে পুলিশ সদর দপ্তরের ফুল ইন্টারসেপশন সেল (এলআইসি), কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল (সিসিটিসি) ইউনিটের সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগ, অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাইবার পুলিশ সেন্টার, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) সাইবার অপরাধ তদন্ত বিষয়ক সেল, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি), তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের সাইবার হেল্প ডেস্ক এবং ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি)।
খবর: সারাক্ষণ