করোনা মহামারিতে ১০ মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পর শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরাতে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ জন্য আগামী ৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মচারীদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)।
মাউশির এ নির্দেশনার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ইস্যুতে জোরালো আলোচনা শুরু হয়েছে। অধিকাংশ শিক্ষার্থী ও অভিভাবক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার পক্ষে। একই সঙ্গে স্বাস্থ্যবিধি মানার ওপর জোর দিচ্ছেন তারা।
সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক শাহনাজ আনজুম বলেন, ‘স্কুল তো খুলতেই হবে। অনেক দিন ধরে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা কার্যক্রম থেকে দূরে আছে। স্কুল-কলেজ কখন খুলবে, সে সিদ্ধান্তটা সরকার নেবে। তবে খোলার আগে স্বাস্থ্যবিধি মেনে খোলা উচিত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্কুল খুলে দিয়েছে।’
আনজুম বলেন, ‘করোনার কারণে অনলাইনে পাঠদান চলছে। কিন্তু মূলত অনলাইনে শিক্ষাটা হয় না। আবার যারা গ্রামে থাকে তারা অনলাইনেও শিক্ষা নিতে পারছে না, তারা বঞ্চিত হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে দেরি হওয়ায় তারা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া উচিত।’
অভিভাবক লিপি রানী বসুর ছেলে পরমব্রত কুণ্ডু পড়ে মিরপুর ১৩ নম্বরে এসওএস হারম্যান মেইনার কলেজের ষষ্ঠ শ্রেণিতে। মেয়ে লাবণ্য কুণ্ডু পড়ে শহীদ আনোয়ার গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজে।
লিপি রানী বসু বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখন খুলে দেয়া দরকার। শিক্ষার্থীরা অনেক দিন শিক্ষার বাইরে রয়েছে। এভাবে থাকলে একাডেমিকভাবে তাদের ক্ষতি হবে। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার আগে স্বাস্থ্যবিধির ব্যাপারে গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মচারী ও শিক্ষার্থীরা যাতে শতভাগ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে, তা নিশ্চিত করতে হবে।’
স্কলাস্টিকা স্কুলের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক সাইফুর রহমান বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললে নবম-দশম শ্রেণির ওপরের ক্লাসগুলো খোলা উচিত। এর নিচের শ্রেণি খোলা উচিত নয়। ওপরের ক্লাসের শিক্ষার্থীরা কিছুটা স্বাস্থ্যসচেতন। তারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে পারবে। কিন্তু নিচের ক্লাসের ছাত্রছাত্রীরা খুব বেশি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে পারবে না। এ ছাড়া নিচের দিকের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের অভিভাবকরা স্কুলে গিয়ে বসে থাকবেন। এতে বেশি মানুষের উপস্থিতি বাড়বে। ফলে ঝুঁকি বাড়বে। নিচের ক্লাসের জন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করা উচিত।’
একটি বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা মো. মোস্তফা তালুকদার বলেন, ‘অনেক দিন হলো, এবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিলে ভালো। অনলাইনে ক্লাস চলছে। এতে কেউ ক্লাস করতে পারছে, কেউ পারছে না। অনলাইনে শিক্ষাটাও সঠিকভাবে হয় না। করোনার ভ্যাকসিনও চলে আসছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে এবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া উচিত।’
বনানীর একটি কর্পোরেট অফিসের কর্মকর্তা নাজমুল ইসলামের মেয়ে রাইদা ইসলাম কারিমা পড়ে বনশ্রী আইডিয়াল স্কুলের নবম শ্রেণিতে, ছেলে পড়েন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি বলেন, ‘অনলাইনে ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা ভালো হচ্ছে না। এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া উচিত। ক্লাসের পড়াশোনাটা খুবই জরুরি। অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে খুলতে হবে।’
নটর ডেম কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী আবরারুল ইসলাম বলেন, ‘অবশ্যই স্কুল-কলেজ খুলে দেয়া উচিত। আমরা সরাসরি কলেজে গিয়ে পড়াশোনা করতে চাই। তবে অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে সব করতে হবে।’
কুর্মিটোলা হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী সাফওয়ান হাসান ফাইয়াজ বলেন, ‘এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে কলেজ খুলে দেয়া গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। না খুললেও আমার তেমন ক্ষতি নেই। যারা এসএসসি ও এইচএসসি দেবে, তাদের জন্য খুলে দেয়া গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্যবিধি যতই মেনে চলা হোক তারপরও একসময় দেখা যাবে কোনো কিছুই মানা হচ্ছে না। মানুষের সমাগম বাড়বেই।’
বাংলাদেশের শিক্ষার সার্বিক অবস্থা নিয়ে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করে ‘এডুকেশন ওয়াচ’। করোনা মহামারিতে শিক্ষার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে গবেষণা করেছে সংস্থাটি। তাদের গবেষণায় করোনার প্রভাবে শিক্ষার নানা দিক উঠে এসেছে। সম্প্রতি তাদের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ক্লাসে ফিরতে চায়। ৭৬ শতাংশ অভিভাবক স্কুল খুলে দেয়ার পক্ষে মতামত দিয়েছেন। ৭৩ শতাংশ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা স্কুল খুলে দেয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। ৮০ শতাংশ এনজিও কর্মকর্তা, ৫৮ শতাংশ শিক্ষক, ৫২ শতাংশ উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা সতর্কতার সঙ্গে স্কুল খুলে দেয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন।
এডুকেশন ওয়াচের গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫৩ শতাংশ শিক্ষক মনে করেন, বিদ্যালয় খুলে দেয়ার আগে বিদ্যালয়গুলোকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যঝুঁকিমুক্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে। ৪৫ শতাংশ শিক্ষক মনে করেন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য শিক্ষার্থীদের ক্লাসে আসন বিন্যাস পরিবর্তন প্রয়োজন।
গবেষণায় বলা হয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৪৮ শতাংশ শিক্ষক মনে করেন, বিদ্যালয় খুলে দেয়ার আগে ক্যাম্পাস নিরাপদ করার উদ্যোগ নিতে হবে। ৫০ শতাংশ শিক্ষক মনে করেন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য শিক্ষার্থীদের ক্লাসে বসার আসন বিন্যাসে পরিবর্তন আনতে হবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৮৪ শতাংশ ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৭৭.৫ শতাংশ শিক্ষক মনে করেন, বিদ্যালয়ের টয়লেটসহ পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নতি করা দরকার।
শুক্রবার (২২ জানুয়ারি) মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) দেয়া নির্দেশনায় বলা হয়- স্কুল, কলেজ, উচ্চমাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানদের জানানো যাচ্ছে যে, এখন আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে হবে। আপনারা জানেন যে, কোভিড-১৯ মহামারি চলাকালীন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক-কর্মচারীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা। সেই লক্ষ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো প্রস্তুত করার জন্য ‘গাইড লাইন’ তৈরি করা হয়েছে।