রমজান আলী পেশায় তাঁত শ্রমিক। হঠাৎ ২০১৯ সালে মাত্র সাড়ে ৩ লাখ টাকায় মালয়েশিয়ায় শ্রমিক হিসেবে যাওয়ার প্রস্তাব পান। সবকিছে বিক্রি করে চক্রের হাতে তিন দফায় ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা তুলে দেন। ভিসা, পাসপোর্ট সব দায়িত্ব নেয় এসএম এন্টারপ্রাইজ। মেডিকেল পরীক্ষা শেষে ২০১৯ সালের ৭ মে আরও ২৩ জনের সাথে ছিল তার মালয়েশিয়া যাওয়ার ফ্লাইট। দিনক্ষণ নির্ধারণ হওয়ায় আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মীয়-স্বজন পরিবার এ এলাকাবাসীর কাছ থেকে বিদায় নেন রমজান আলী। তবে ঢাকায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছার পর জানতে পারেন তিনি প্রতারণার শিকার। যাদের হাতে তিনি টাকা দিয়েছেন সেই রিপনসহ সকলের যোগাযোগের নম্বর বন্ধ। এরপর ফিরে যান তিনি। ঘুরে ঘুরে মালয়েশিয়া যেতে না পেরে কিংবা টাকা ফেরত না পেয়ে চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি সিআইডিতে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী রমজান আলী।
রাজধানীর পল্লবীতে অভিযান পরিচালনা করে গতকাল রবিবার রাতে এসএম এন্টারপ্রাইজ নামক ও ভুয়া প্রতিষ্ঠানটির দুই সদস্যকে গ্রেফতার করে সিআইডি’র ঢাকা মেট্রো পশ্চিমের একটি দল। এ সময় তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন ব্যক্তির ৭১টি পাসপোর্ট, মালয়শিয়ার জাল ভিসা ১১টি, ফ্রান্সের জাল ভিসা তিনটি, ভুয়া বিএমইটি ছাড়পত্রের ফটোকপি ২৪টি, ভুয়া মেডিকেল সার্টিফিকেট ৮টি, ১০ টি ভুয়া বিমান টিকিট জব্দ করা হয়।
সিআইডি বলছে, চাকরির ভিসায় মালয়েশিয়া এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রেরণের নামে প্রতারণা ও মানবপাচার করে আসছিল এসএম এন্টারপ্রাইজ। প্রতিষ্ঠানটির কোনও অনুমোদন নেই। সব কার্যক্রমেই প্রতিষ্ঠানটি প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে সহজ-সরল মানুষের সাথে প্রতারণা করেছে।
সোমবার (১ ফেব্রুয়ারি) সিআইডি কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মেট্রোর অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ ওমর ফারুক বলেন, গ্রেফতার দুজন হচ্ছেন জালিস মাহামুদ (৩২) ও অমল জয়ধর (৪১)। এসএম এন্টারপ্রাইজের পরিচালক জালিস। তারই আপন ভাই পলাতক রিপন মাহমুদ একই প্রতারক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান।
তিনি বলেন, মানব পাচারকারী চক্রের সদস্যরা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বিদেশ গমনেচ্ছুদের মালয়েশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রেরণের কথা বলে লোক সংগ্রহ করছে।
চক্রটি জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষন ব্রাকের অনুমোদন ছাড়া তাদের কোনও রিক্রুটিং এজেন্সি বা লাইসেন্স না থাকা সত্ত্বেও চাকুরির ভিসায় মালয়েশিয়া প্রেরণের কথা বলে টাকা গ্রহণ করে। ভুয়া বিএমইটি ছাড়পত্রের ফটোকপি, ভুয়া টিকেট ও ভিসার কপি, মেডিকেল রিপোর্ট, বিমান টিকিট সরবরাহ করে বিশ্বাস জন্মিয়ে টাকা গ্রহণ করতো।
এক প্রশ্নের জবাবে এ সিআইডি কর্মকর্তা বলেন, ভুক্তভোগী ২৩ জনের বাড়ি সিরাজগঞ্জে তারা মূলত নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের। শ্রমিক হিসেবে মালেশিয়া যাবার জন্যই তারা সবাই মিলে ৬৮ লাখ টাকা তুলে দিয়েছিলেন চক্রটির সদস্যদের হাতে।
ভুয়া পাসপোর্ট ভুয়া মেডিকেল পরীক্ষা সম্পন্ন করে চক্রটি। এরপর গত ২০১৯ সালের ৭ মে তাদের মালয়েশিয়া পাঠানোর দিনক্ষণ নির্ধারণ করা হয়। সরল ভুক্তভোগীরা তাদের কথামতো খুশি হয়ে এলাকা থেকে পরিবার থেকে বিদায় নিয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসেন। সেখানে আসার পরে তারা বুঝতে পারেন তারা প্রতারণার শিকার হয়েছেন।
চক্রের প্রত্যেকটি সদস্যদের মোবাইল ফোন বন্ধ করে গাঁ-ঢাকা দেয়। এরপর তারা প্রায় এক বছর চেষ্টা করেও চক্রের সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি। গত বছরে চেয়ারম্যান রিপনের সন্ধান পায় তারা। তখন তারা রিপনের কাছে টাকা দাবি করে। রিপন আবারো তাদের মালয়েশিয়া পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু মালয়েশিয়া না পাঠিয়ে ও টাকা ফেরত না দিয়ে রিপন আবারও গা ঢাকা দেয়।
এরপর ভুক্তভোগীরা সিআইডিতে অভিযোগ করলে গত রাতে চক্রের দুই সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। পলাতক রিপনকে গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে।
গ্রেফতার দুজনের বিরুদ্ধে রাজধানীর বনানী থানায় মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে দায়ের করা মামলায় তাদের আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলন শেষে ভুক্তভোগী রফিকুল ইসলাম বলেন, আগে তিনি জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করতেন। মালয়েশিয়া যাবার প্রলোভনে চক্রটির খপ্পড়ে পড়ে ঋণ করে আড়াই লাখ টাকা দেন তিনি। কিন্তু তিনি না যেতে পেরেছেন মালয়েশিয়া না পেয়েছেন টাকা ফেরত। এখন তিনি ঢাকায় রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
অপর ভুক্তভোগী আবু হানিফও সিরাজগঞ্জের তাঁত শ্রমিক। ভালোই চলছিল তার সংসার। কিন্তু বেশি টাকা রোজগারের প্রলোভনে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য চক্রের খপ্পরে করে আড়াই লাখ টাকা দেন।
তিনি বলেন, এভাবে প্রতারণার শিকার হবো ভাবিনি। গরীব অশিক্ষিত মানুষ বুঝতে পারিনি। প্রতারণার শিকার হবার পর সিআইডিকে জানিয়েছি। মালয়েশিয়া যাওয়ার আশা ছেড়ে দিলেও তিনি টাকা ফেরতের আশা ছাড়েননি।