ঢাকার পল্লবীতে প্রকাশ্যে ছেলের সামনে বাবা সাহিনুদ্দিনকে কুপিয়ে হত্যার মামলার এজাহারভুক্ত আসামি মানিক র্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। শুক্রবার ভোরে মিরপুরের রূপনগর ইস্টার্ন হাউজিং এলাকায় গোলাগুলিতে মানিক মারা যায়। এদিকে একইদিন আলোচিত এই হত্যা মামলার এক নম্বর আসামি লক্ষ্মীপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও তরীকত ফেডারেশনের সাবেক মহাসচিব এম এ আউয়ালের চারদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে শুক্রবার এম এ আউয়ালকে হাজির করে পুলিশ। এ সময় মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য তাকে ১০ দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক সৈয়দ ইফতেখার হোসেন। শুনানি শেষে ঢাকা ঢাকা মহানগর হাকিম নিভানা খায়ের জেসি তার চারদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এর আগে গত বৃহস্পতিবার ভৈরব এলাকা থেকে হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী আউয়ালকে গ্রেফতার করে র্যাব।
এক বছর আগেও সাহিনুদ্দিনকে হত্যার চেষ্টা করা হয়:
সাহিনুদ্দিনকে হত্যার চেষ্টা এক বছর আগেও হয়েছিল। ওই ঘটনায় মামলাও করেছিল তার পরিবার। কিন্তু কারও কোনো শাস্তি হয়নি। এ বছর তিনি খুনই হয়ে গেলেন। সাহিনুদ্দিন গত ১৬ মে খুন হওয়ার পর তার মা আকলিমা বেগম ২০ জনকে আসামি করে মামলা করেন। গত বছর সাহিনুদ্দিনকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে আকলিমা যে মামলা করেছিলেন, সেই মামলার অধিকাংশ আসামিকেই এবারের হত্যা মামলারও আসামি করা হয়েছে।
আকলিমা বলেন, এর আগে গত বছরও ওরা আমার ছেলেকে হত্যার চেষ্টা করেছিল। ওই ঘটনায় থানায় মামলাও করেছিলাম। ওরা জামিনে বের হয়ে এলাকায় বুক ফুলিয়ে চলে। আমরা সব সময় ভয়ে থাকতাম। যা ভাবতাম শেষে সেটাই হলো। আমার ছেলেকে ওরা হত্যা করল।
ঢাকার পল্লবীর উত্তর কালশীর সিরামিক এলাকার বাসিন্দা আকলিমার দুই ছেলের মধ্যে সাহিনুদ্দিন ছোট। তার বড় ছেলে মাঈনুদ্দীন। বাউনিয়া মৌজার উত্তর কালশীর বুড়িরটেকের আলীনগর আবাসিক এলাকায় ১০ একর জমি রেখে গেছেন আকলিমার প্রয়াত স্বামী। আর সেই জমি দখল করতেই তার সন্তানকে খুন করা হয়েছে বলে আকলিমার অভিযোগ।
এই হত্যা মামলার প্রধান আসামি লক্ষ্মীপুরের সাবেক সংসদ সদস্য ও তরীকত ফেডারেশনের সাবেক মহাসচিব এম এ আউয়াল, হাভেলি প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড নামে যার আবাসন ব্যবসা রয়েছে মিরপুরের ওই এলাকায়।
আকলিমা জানান, গত বছরের জুলাইয়ে তার স্বামীর মৃত্যুর পর জমিটি দখল করতে তার দুই ছেলেকেই হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। আর সেজন্যই গত বছরের নভেম্বরে তার দুই ছেলের ওপরে হামলা হয়েছিল। এরপর সাহিনুদ্দিন ও মাইনুদ্দিনকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ এনে গত বছরের ২৬ নভেম্বর মামলা করেছিলেন তিনি।
তিনি জানান, গত রোববার সাইনুদ্দিনকে ফোন করে ডেকে নেওয়া হয়েছিল বিবাদ মিটমাটের কথা বলে। আর ডেকে নিয়ে করা হয় হত্যা। আউয়াল এবং তার কোম্পানির কর্মকর্তা আবু তাহেরের পরামর্শে ও প্ররোচনায় সুমন ও টিটু নামে দুজন সাহিনুদ্দিনকে ডেকে নিয়েছিল।
আউয়ালকে গ্রেফতারের পর র্যাব জানায়, এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে ছিল জমি নিয়ে দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বের জেরেই লক্ষ্মীপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এমএ আউয়ালের নির্দেশনায় ছেলের সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে সাহিনুদ্দিনকে খুন করে পল্লবীর চিহ্নিত সন্ত্রাসী কিলার সুমন ও তার দলবল। খুন করার পর আওয়ালকে ফোন করে সুমন বলে ‘স্যার ফিনিস’।
হত্যাকাণ্ডের চার-পাঁচদিন আগে মূল পরিকল্পনাকারী, নির্দেশদাতা ও মামলার প্রধান আসামি আউয়ালের কলাবাগান অফিসে ২ নম্বর আসামি আবু তাহের ও ৩ নম্বর আসামি সুমন হত্যাকাণ্ডের চূড়ান্ত পরিকল্পনা করেন। বিষয়টি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয় সুমনকে। সুমনের নেতৃত্বে প্রায় ১০-১২ জন কিলিং মিশনে অংশ নেয়।
মীমাংসার কথা বলে আগে থেকেই শাহীনকে ঘটনাস্থলে আসতে বলা হয়েছিল। প্রথমে সুমন, মনির, মানিক, হাসান, ইকবাল ও মুরাদসহ ১০-১২ জন ধারালো অস্ত্র দিয়ে শাহীনকে এলোপাথাড়ি আঘাত করতে থাকে। ঘটনার শেষ পর্যায়ে শরীরের ওপরের অংশে মনির এবং হাঁটু ও হাত-পায়ে কুপিয়ে মানিক শাহীনের মৃত্যু নিশ্চিত করে। মৃত্যু নিশ্চিত হলে সাবেক এমপি আউয়ালের মোবাইলে ফোন করে সুমন বলেন, ‘স্যার ফিনিসড।’ এরপর হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়া ব্যক্তিরা দেশের বিভিন্ন এলাকায় গা ঢাকা দেয়।
সাহিনুদ্দিন হত্যাকাণ্ডে এখন পর্যন্ত সাতজন গ্রেফতার:
সাহিনুদ্দিন হত্যাকাণ্ডের পর এখন পর্যন্ত আউয়ালসহ সাতজনকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
আউয়ালকে কিশোরগঞ্জের ভৈরবের একটি মাজার থেকে বৃহস্পতিবার ভোররাতে গ্রেফতার করে র্যাব। এর আগে বুধবার জহিরুল ইসলাম বাবু ও হাসান নামে দুজনকে গ্রেফতার করা হয়।
এর আগে হত্যার ঘটনার পরদিন র্যাব দিপু নামে আরও একজনকে গ্রেফতার করে থানা পুলিশের কাছে সোপর্দ করে। এছাড়া বুধবার মধ্যরাতে সুমন বেপারী ও রকি তালুকদার নামে দুজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এর আগে গ্রেফতার করা হয় মুরাদ নামে আরেকজনকে।
মামলার তদন্ত সংস্থা গোয়েন্দা পুলিশের মিরপুর বিভাগের অতিরিক্ত উপ কমিশনার আহসান খান দৈনিক খোলাকাগজকে বলেন, এখন পর্যন্ত এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। জমির বিরোধ নিয়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। তবে এর পেছনে অন্য কোনো বিষয় রয়েছে কি-না, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অতিদ্রুতই হত্যার সাথে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত সকল আসামিদের গ্রেফতার করা সম্ভব হবে।
বন্দুকযুদ্ধে হত্যা মামলার আসামি মানিক নিহত:
সাহিনুদ্দিন হত্যা মামলার আসামি মানিক র্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। শুক্রবার ভোরে মিরপুরের রূপনগর ইস্টার্ন হাউজিং এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন দৈনিক খোলাকাগজকে বলেন, কয়েকজন সন্ত্রাসী অস্ত্র নিয়ে রূপনগর ইস্টার্ন হাউজিং এলাকায় অবস্থান করছে খবর পেয়ে শুক্রবার ভোরে সেখানে যায় র্যাবের একটি দল। র্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে সন্ত্রাসীরা গুলি ছোড়ে। র্যাবও তখন পাল্টা গুলি চালায়। মিনিট দশেক গোলাগুলির পর সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়। পরে একজনকে সেখানে পড়ে থাকতে দেখা যায়। তাকে উদ্ধার করে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
তিনি আরও বলেন, স্থানীয়রা ওই যুবককে মানিক হিসেবে শনাক্ত করেছেন। যে দুজন সাহিনুদ্দিনকে কুপিয়ে হত্যা করেছিল, সে তাদের একজন। ভিডিওতে দেখা যায়, মানিক সাহিনুদ্দিনের পায়ের দিকে কোপাচ্ছিল।
পল্লবী থানার ওসি কাজী ওয়াজেদ আলী জানান, সাহিনুদ্দিনকে গত রোববার প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় তার মা আকলিমা বেগম যে ২০ জনকে আসামি করে মামলা করেছেন, সেখানে মানিকের নামও রয়েছে। ২৪ বছর বয়সী মানিক ওই হামলায় সরাসরি অংশ নেন এবং সাহিনুদ্দিনের শরীরের বিভিন্ন অংশে কোপান বলে অভিযোগ করা হয়েছে মামলার এজাহারে।