জমে উঠেছে শত বছরের পুরানো দেশের বৃহত্তম মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার বৃহত্তম নৌকার হাট। পদ্মা, যমুনা, কালীগঙ্গা, ইছামতি, ধলেশ্বরীসহ ছোট বড় বেশ কয়েকটি নদী বেষ্টিত জেলা মানিকগঞ্জ। নদ নদীতে পানি বৃদ্ধির ফলে ঘিওর ও পাশ্ববর্তী দৌলতপুর উপজেলার নিম্নাঞ্চলে পানি প্রবেশ করতে শুরু করেছে। এ কারণে বর্ষার শুরু থেকেই নিম্নাঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর বর্ষা মৌসুমে এক মাত্র ভরসা হলো নৌকা। জেলার চারটি উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে নিম্নাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষ আগাম প্রস্তুতির জন্য নৌকার হাটে আসতে শুরু করেছে। সাধ্যের মধ্যে নৌকা কেনা বেচায় মুখরিত হয়ে উঠছে হাট। এসব নিম্নাঞ্চলের মানুষের মালামাল পরিবহন ও যাতায়াতের একমাত্র বাহন হয়ে উঠেছে নৌকা।
ঘিওর, দৌলতপুর, শিবালয়, সদর, হরিরামপুরের বেশিরভাগ এলাকায় বর্ষায় রাস্তা ঘাট ডুবে যায়, বাড়ি ঘরে বর্ষার পানি উঠে। তখন নৌকা ছাড়া চলাফেরা করা সম্ভব নয়। তাই বর্ষা আসার আগেই এসব অঞ্চলের মানুষজন নৌকা ক্রয় করতে ছুটে আসেন ঘিওর হাটে।
নৌকাশিল্পের জন্য বিখ্যাত ঘিওরের কারিগরদের তৈরি নৌকা এ জেলার চাহিদা মিটিয়ে বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন জেলায়। নৌকা তৈরির কাজে ব্যস্ত সময় কাটছে মিস্ত্রিপাড়ার নারী-পুরুষদের। তাদের যেন দম ফেলার অবকাশ নেই। নৌকার কাঠামো তৈরিতে মেহগনি, কড়ই, আম চাম্বল এবং রেইন্টি কাঠের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে।
সরেজমিনে দেখা যায়, মহামারি করোনার জন্য সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ঘিওর উপজেলা কেন্দ্রীয় ঈদগাঁ জামে মসজিদ মাঠে জমে উঠতে শুরু করেছে নৌকার হাট। ওই হাটে ক্রেতাদের জন্য থরে থরে সাজানো রয়েছে বাহারি হাজারো নৌকা। এখানে সাধ্যের মধ্যে সব শ্রেণি পেশার মানুষের জন্য রয়েছে নানা ধরনের নৌকা।
ঘিওর বাজারের কাঠমিস্ত্রী রবি সূত্রধর, নিলকমল সূত্রধর, মাসুদ ও হারেছ জানান, বর্ষা মওসুমে তারা নৌকা তৈরিতে ব্যস্ত। সপ্তাহে তাদের কারখানা থেকে ২০টির মতো নৌকা হাটে যায়। বর্তমানে কাঠ, লোহা ও অন্যান্য সরঞ্জামাদীর দাম বেড়ে যাওয়ায় নৌকা তৈরিতে খরচ বেড়েছে। নৌকার আকার ও প্রকারভেদে তিন থেকে পনের হাজার টাকায় বিক্রি হয়। তবে লাভের অংশ আগের থেকে কমে গেছে।
কাঠমিস্ত্রি সুবল দাস জানান, তিনি দাদার আমল থেকেই দেখছেন নৌকা বানানো। বর্ষা এলেই ধুমধাম শব্দ হয় মিস্ত্রিপাড়ায়। বর্ষা মওসুম শুরুর কিছু আগে অর্থাৎ জ্যৈষ্ঠ মাস থেকে তারা নৌকা তৈরি শুরু করেন এবং ভাদ্র মাস পর্যন্ত চলে। বর্তমানে ছোট ডিঙি ও কোষা নৌকার কদর বেশি। কড়ই, জাম্বল, আম ও কদম কাঠের নৌকা বেশি চলে। তিনি দুঃখ করে বলেন, ‘সরকারি সুযোগ-সুবিধা না থাকায় আমরা এ ব্যবসায় অনেক কষ্ট দুঃখের মধ্যে টিকে আছি’।
ঘিওরের বানিয়াজুড়ি, বালিয়াখোড়া, সিংজুরী ও বেগুন নারচী, দৌলতপুর উপজেলার জিয়নপুর, বাঁচামারা, বাঘুটিয়া, চরকাটারি, খলসী, ধামশ্বর, কলিয়া ও বিনোদপুর এবং শিবালয়ের কয়েকটি গ্রামের মানুষ বর্ষার আগাম প্রস্তুতিতে জমায়েত হয়েছেন ঘিওরের নৌকার হাটে। সপ্তাহের প্রতি বুধবার হাটের দিন হওয়ায় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিক্রেতারা নৌকা সারিবদ্ধভাবে সাজিয়ে রাখেন। এ ছাড়াও প্রায় সারা সপ্তাহ জুড়েই কম-বেশি বিক্রি হয় নৌকা।
ঘিওর হাটে নৌকা বিক্রি করতে আসা খগেন সূত্রধর জানান, ১০ হাত লম্বা এবং আড়াই হাত প্রস্থের একটি নৌকার মূল্য চার হাজার টাকা। এরকম ১১/৩ সাইজের নৌকা ৫ হাজার, ১৩/৩ সাইজের দাম ৭ হাজার, ১৫/৩ সাইজের নৌকা বিক্রি করেন আট থেকে নয় হাজার টাকার মতো। এ ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের স্টিলের নৌকা বিক্রি করেন তিনি। এসব নৌকা তৈরীতে খরচ একটু বেশি, দামও বেশি। টেকে বেশি দিন।
নৌকার মিস্ত্রী জাবরা গ্রামের কানাই সূত্রধর বলেন, লকডাউনের জন্য সব জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ার এ বছর কিছুটা খরচ বেশি হচ্ছে নৌকা তৈরি করতে। আর সে অনুযায়ী নৌকার দাম অন্যন্যা বছরের তুলনায় একটু বেশি। নৌকার দর একটু বেশি হওয়ায় হাটে নৌকার বেচাকেনা কম হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সিংজুরী এলাকার রাসেল মিয়া নামক এক ক্রেতা জানান, প্রতি বছর বর্ষায় তার একটি করে নৌকা কিনতে হয়। তবে এ বছর নৌকার দাম একটু বেশি বলে মন্তব্য করেন তিনি। তারপরও বাড়ির কাছাকাছি এলাকায় তৈরি নৌকা কিনতে পারায় অনেক খুশি তিনি।
উপজেলার বানিয়াজুরী ইউনিয়নের রাথুরা গ্রামের মোঃ বারেক নামে এক ক্রেতা বলেন, তিনি বর্ষা মৌসুমে মাছ শিকার করে সংসার চালান। তাই নৌকা কিনতে এসেছেন। সাড়ে আট হাজার টাকা দিয়ে তিনি একটি নৌকা ক্রয় করেছেন।
ঘিওর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হাবিবুর রহমান বলেন, এত বড় নৌকার হাট আমার নজরে আর কোথাও পড়েনি। এই নৌকার হাটটি আমাদের জেলা ও উপজেলার ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে। আমার জন্মের পর থেকে দেখে আসছি এই নৌকার হাটটি। আর তিন পুরুষের কাছে গল্প শুনেছি এই হাটের ইতিহাস ঐতিহ্যের কথা। আমাদের এই উপজেলায় নৌকার হাটের সুনাম রয়েছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এ হাটেনৌকা কিনতে আসে বিভিন্ন মানুষ।