আজ ১১ বছর! মেয়ে হত্যার প্রকৃত বিচার পাবার আশায় দ্বারে দ্বারে ঘুরে ক্লান্ত ফেলানীর মা-বাবা। কুঁড়ি ফোঁটার আগে ঝড়ে যাওয়া একটি ফুলের নাম ছিল ফেলানী। গরীব ঘরে জন্ম নেয়া ফেলানী যে ভাঙা কুলোর মতো বন্ধুরাষ্ট্রের পাত্র হবে কে জানতো?
ফেলানীকে হত্যা করে যেমন কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রেখেছিল ওরা। তেমনি বিচার ব্যবস্থাটাও ১১ বছর ধরে ঝুলে আছে যেন কাঁটাতারের উপরেই।
সময়টা ছিল শীতকাল। প্রতিদিনের মত ঘাসের ডগায় শিশির ফোঁটা জমে হতো মুক্তদানা। দিগন্তে উঁকি দিয়ে হেঁসে উঠতো সূর্য। ফেলানীর হাস্যোজ্জ্বল মুখ, আর স্বদেশে ফেরার উল্লাসে হয়তো পাড়ার মানুষের সেদিন ঘুম ভাঙ্গত। কিন্তু না, বাবার হাত ধরে হাজার স্বপ্ন নিয়ে ফিরে আসা মেয়েটার সব স্বপ্ন উড়িয়ে গুলির শব্দে সেদিন ঘুম ভাঙ্গে বাংলাদেশের।
সেদিন শিশির জমেনি। বুক চিড়ে ঘাসের ডগা বেয়ে নুয়ে পড়েছিল ফেলানীর রক্ত। জমাট বাঁধা রক্তে জমে ছিল ফেলানীর পুষে রাখা স্বপ্ন। সূর্যের সেদিনটা ছিল মন খারাপের দিন। আকাশ-বাতাস ভারী হয়েছিল গুলির শব্দে। সেদিন অমিয় ঘোষের গুলিতে শুধু ফেলানীর বুক কেঁপে ওঠেনি, কেঁপে উঠেছিল গোটা বাংলাদেশ।
শুক্রবার (৭ জানুয়ারি) সেই কিশোরী ফেলানী হত্যার ১১ বছর। ফুলবাড়ী অনন্তপুর সীমান্তে ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি কাঁকডাকা ভোরে নিজ দেশে ফেরার সময় বিএসএফ অমিয় ঘোষের গুলিতে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর আধাঘণ্টা মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করা ফেলানীর দৃশ্য দেখে আনন্দে মেঁতেছিল ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী। এতেই খান্ত হননি, ভোর হতে টানা সাড়ে চার ঘণ্টা কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রেখেছিল ওই অমিয় ঘোষের দল।
এ ঘটনায় গণমাধ্যমসহ বিশ্বের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে ভারত। অবশেষে ২০১৩ সালের ১৩ আগষ্ট ভারতের কোচবিহারে জেনারেল সিকিউরিটি ফোর্সেস কোর্টে ফেলানী হত্যার বিচার শুরু হয়।
বিএসএফ’র এই কোর্টে সাক্ষী দেন ফেলানীর বাবা ও মামা হানিফ। ওই বছরের ৬ সেপ্টেম্বর মুল আসামি অমিয় ঘোষকে খালাস দিলে রায় প্রত্যাখান করে পুনরায় বিচারের দাবি জানায় ফেলানীর বাবা নূর ইসলাম।
২০১৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর পুনরায় বিচার শুরু হলে ১৭ নভেম্বর আবারও আদালতে সাক্ষী দেন ফেলানীর বাবা। পরে আদালত আত্মস্বীকৃত আসামি অমিয় ঘোষকে আবারও খালাস দেয়। পক্ষপাতিত্ব বিচার ব্যবস্থা দেখে হতাশ হয়ে ফেরে ফেলানীর পরিবার।
এভাবে ২০১৫, ২০১৬ এবং ২০১৭ সালে কয়েক দফা শুনানির দিন পিছিয়ে যায়। পরে ২০১৮ সালের ২৫ জানুয়ারি শুনানির দিন ধার্য হলেও সেদিনের পর থেকে এ পর্যন্ত কোনো দিন ধার্য হয়নি।
এদিকে মেয়ের হত্যাকারীর প্রকৃত বিচার না পেয়ে ১১ বছর ধরে হতাশার কাফন পড়ে অনিশ্চিত আশায় দিন গুনছে ফেলানীর মা-বাবা। পরিবারের দাবি দ্রুত বিচার ও হত্যাকারির উপযুক্ত শাস্তি হোক।
ফেলানীর বাবা নূর ইসলাম জানান, ফেলানী হত্যার বিচার চেয়ে অনেক ঘুরেছি, মানবাধিকার সংস্থাসহ বহুজনের কাছে গেছি, প্রকৃত বিচার পেলাম না। আমরা গরীব মানুষ, টাকা-পয়সা নাই। সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি। আর পারছি না, ক্লান্ত হয়ে গেছি।
ফেলানীর মা জাহানারা বেগম জানান, আমার মেয়ে ফেলানী হত্যার ১১ বছর হলো—আজও বিচার পাইনি। আমি দুই দেশের সরকারের কাছে সঠিক বিচার দাবি করছি। সেইসঙ্গে আমার মেয়ে হত্যার ক্ষতিপূরণের দাবি করছি।
লিগ্যাল এইড বাংলাদেশ মানবাধিকার কর্মী অ্যাড. মহব্বত আলী জানান, সীমান্ত হত্যা আমরা মোটেই আশা করি না। কেননা, হত্যাকাণ্ড কোনো স্বাধীন রাষ্ট্রের কাম্য নয়। দুই দেশের প্রচলিত সংবিধান আছে, আইন আছে। কেউ অবৈধ অনুপ্রবেশ করলে কিংবা অপরাধী হলে আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত।
ফেলানী হত্যা মামলার অ্যাড. আব্রাহাম লিংকন (পাবলিক প্রসিকিউটর, কুড়িগ্রাম) বলেন, ‘আইনে আছে কোনো মামলার রায়ে সন্তুষ্ট না হলে বাদীপক্ষ উচ্চ আদালতে যেতে পারে। আইনি প্রক্রিয়ায় সে কাজটি করেছে ফেলানীর বাবা। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট রিটটি আমলে নিয়েছে। শুনানির দিন ধার্য করেছে। পরে পিছিয়েছে। এরপর যদিও বিশ্বব্যাপী করোনার একটা প্রভাব ছিল। তার জন্য বিলম্ব হতে পারে। তবে তিন বছর থেকে মামলাটি শুনানির তালিকায় না থাকা খুবই দুঃখজনক। এরপরও আমরা আশা করছি ন্যায়বিচার পাব।’
উল্লেখ্য, কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার রামখানা ইউনিয়নের কলোনীটারী গ্রামের নুরুল ইসলাম নুরুর মেয়ে কিশোরী ফেলানী স্বপরিবারে থাকতেন ভারতের বঙ্গাইগাঁও গ্রামে। সেখান থেকে বাবার সঙ্গে বাংলাদেশে নিজ বাড়িতে আসার পথে মই বেয়ে কাঁটা তার পার হওয়ার সময় বিএসএফ’র গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন।
খবর- সিটি নিউজ ঢাকা-