সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবারের সকালে গানের সুরে, নাচের ছন্দে, কবিতার আবৃত্তিতে শুরু হলো শরৎ উৎসব। শুক্রবার (২৩ সেপ্টেম্বর) সকাল সাড়ে ৭টায় ঢোলবাদক স্বপন মিঞায় বাংলাঢোলের বোলে সূচনা হয়েছিল উৎসবের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠীর আয়োজনে ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় এই উৎসব আয়োজন করা হয়েছে। শরৎ বন্দনা করে একক ও দলীয় গান, নৃত্য ও আবৃত্তি দিয়ে সাজানো হয়েছিলো এই উৎসব। শরতের সকাল মুখরিত হয়েছিল প্রাণ প্রকৃতির কবিতা, গান, কথায়।
শরৎ কথন পর্বে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠীর সহসভাপতি ড. নিগার চৌধুরী, স্বাগত বক্তব্য দেন সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী সুইট।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বলেন, আমাদের দেশে ঋতুর আবির্ভাবের অনুষ্ঠান শুরু করেছে ছায়ানট। পহেলা বৈশাখ উদযাপনের মধ্য দিয়ে তারা ঋতুকে আমন্ত্রণ জানানোর অনুষ্ঠান শুরু করেছিল। এখন সারাদেশে প্রত্যেক ঘরে ঘরে ধর্ম বর্ণ মত নির্বিশেষে প্রত্যেকে পহেলা বৈশাখ পালন করছে। এর ধারাবাহিকতায় শরৎ উৎসব স্বচ্ছতার আনন্দ নিয়ে আমাদের মধ্যে আসে। সবকিছুর ঊর্ধ্বে শরত আমার সবচেয়ে পছন্দের একটি ঋতু। এ সময় কাশফুল দেখা যায়। স্বচ্ছ নীলাকাশে সাদামেঘ-এগুলো খুবই উপভোগ্য। তবে জীবনের ব্যস্ততায় এটিকে খুব উপভোগ করা অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে।
ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বলেন, শরৎ বাঙালি সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে রূপান্তরিত হয়েছে। শরতের কিছু আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে যা কবিদের লেখনীতে ফুটে উঠেছে। যেমন: আকাশ, কাশফুল, শিউলি ইত্যাদি। শরতের সুবিশাল আকাশ যেন আমাদের মনকে আরও প্রশস্ত করে। তবেই আমরা আরো অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক হতে পারব।
গোলাম কুদ্দুছ বলেন, জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই এমন সাংস্কৃতিক, ঋতুভিত্তিক অনুষ্ঠান আরও বেশি পালন করতে হবে। কারণ এগুলো অসাম্প্রদায়িক বাঙালির উৎসব। সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আরেকটি বড় লক্ষ্য এ ধরণের অনুষ্ঠান। এসময় তিনি শরৎ উৎসব আয়োজনের জন্য সত্যেন সেন শিল্পী গোষ্ঠীকে অভিনন্দন জানান এবং সকলেই বাঙালির এমন অনুষ্ঠানগুলো উপভোগ করে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে তার বৈশিষ্ট্য ধারণ করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
নিগার চৌধুরী বলেন, সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী এই উৎসব করে নগর জীবনে মানুষ যখন প্রকৃতির দিকে তাকাবার সুযোগ পায় না, তখন তাদের জানান দিতে যে শরৎ ঋতু এসেছে। শরৎ হচ্ছে সমৃদ্ধির ঋতু। এসময় তিনি বাংলাদেশের চলমান উন্নয়নের পাশাপাশি সংস্কৃতি পালনের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার দিকে এগিয়ে যেতে সকলকে আহ্বান জানান।
একক আবৃত্তি পর্বে নায়লা তারান্নুম চৌধুরী কাকলি পাঠ করেন নির্মলেন্দু গুণের ‘কাঁশফুলের কাব্য’, আহসান উল্লাহ পাঠ করেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছিন্নপত্র’ থেকে। সেবতি প্রভা পাঠ করেন মো. নাসির উদ্দিনের ‘শরৎকাল’ কবিতাটি।
একক সংগীত পর্বে ফাহিম হোসেন চৌধুরী শোনান রবীন্দ্রসংগীত ‘এবার অবগুণ্ঠন খোলো’, অনিমা রায় শোনান ‘শরৎ আলোর কোমল বনে’, বিমান চন্দ্র বিশ্বাস শোনান লোকসংগীত ‘হিংসা হিন্দা ছাড়ো’।
এরপর সঞ্জয় কবিরাজ শোনান নজরুল সংগীত ‘দূর প্রবাসে মন কাঁদে’, আরিফ রহমান শোনান লোকসংগীত ‘চাতুরি করিয়া মোরে’, ফেরদৌসী কাকলী শোনান রবীন্দ্রসংগীত ‘হৃদয়ে ছিলে জেগে’, রত্না সরকার শোনান আধুনিক গান ‘আকাশটা তো নীল চিঠি নয়’। পরে এস এম মেজবা শোনান ‘আরে ও জীবন ছাড়িয়া না যাও মোর’, শ্রাবণী গুহ রায় শোনান আধুনিক গান ‘আমি সুরের পিয়াসী’, নবনীতা জাহিদ চৌধুরী অনন্যা শোনান ‘ভাসে আকাশে শুকতারা হাসে’, তাপসী ঘোষ শোনান কীর্তন ও সবশেষে মারুফ হোসেন শোনান ‘মনে নাইগো আমার বন্ধুয়ার মনে নাই’ শিরোনামে রাধারমণের গান।
দলীয় সংগীত পর্বে বহ্নিশিখা পরিবেশন করে আগমনী সংগীত ‘শিশিরে শিশিরে শারদ আকাশে ভোরের আগমনী’, সুরনন্দনের শিল্পীরা শোনান ‘এসো শারদ প্রাতের প্রতীক’, পঞ্চভাস্করে শিল্পীরা শোনান ‘আজি ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায়’, সুরবিহারের শিল্পীরা গেয়েছেন ‘শিউলি তলায় ভোরবেলায়’, সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠীর সদস্যরা শোনান ‘দেখ দেখ শুকতারা আঁখি মেলে চায়’ ও ‘নম নম নম বাংলাদেশ মম’।
নৃত্য পরিবেশনায় রবীন্দ্রসংগীত ‘ওগো শেফালী ওগো শেফালী’ গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করে নৃত্য সংগঠন ভাবনার শিল্পীরা। ‘আজ শরতে আলোর বাঁশি বাজলো’ গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশনায় ছিল নৃত্যাক্ষ। রবীন্দ্রসংগীত ‘শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলী’ গানের সঙ্গে মঞ্চে আসে নৃত্য সংগঠন নৃত্যজনের শিল্পীরা; বাফার শিল্পীরা পারফর্ম করে নজরুল সংগীত ‘এসো শারদ প্রাতের পথিক’ গানের সঙ্গে। এছাড়া নৃত্য সংগঠন স্পন্দন আগমনী নৃত্য পরিবেশন করে।