আবরারের খুনিদের ফাঁসিসহ ৭ দফা দাবিতে উত্তাল বুয়েট

নিজস্ব প্রতিবেদক | মঙ্গলবার, ৮ অক্টোবর ২০১৯ :
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের খুনিদের ফাঁসিসহ সাত দফা দাবিতে বিক্ষোভ করছেন বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। সকাল থেকে শত শত শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে বুয়েট ক্যাম্পাস উত্তাল হয়ে উঠেছে।
মঙ্গলবার (৮ অক্টোবর) সকাল সাড়ে ১০ টার দিকে বুয়েট ক্যাফেটেরিয়ার সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বুয়েটের বিভিন্ন হল প্রদক্ষিণ করে বুয়েট শহীদ মিনারের সামনে অবস্থান করছেন।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের দাবি, যতক্ষণ না ভিসি স্বশরীরে এসে তাদের ৭ দফা দাবি মেনে নেবে, ততক্ষণ শহীদ মিনারের সামনে অবস্থান করবেন তারা। এ সময় ৭ দফা দাবি মানা না হলে, কাল থেকে রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করার ঘোষণাও দেন শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীদের সাত দফা দাবি গুলো হচ্ছে-
১। খুনীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
২। ৭২ ঘণ্টার মধ্যে নিশ্চিতভাবে সনাক্তকৃত খুনিদের সকলের ছাত্রত্ব আজীবন বহিঃস্কার নিশ্চিত করতে হবে।
৩। দায়েরকৃত মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালের অধীনে স্বল্পতম সময়ে নিষ্পত্তি করতে হবে।
৪। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি কেন ৩০ ঘণ্টা অতিবাহিত হবার পরও ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয় নি তা তাকে স্বশরীরে ক্যাম্পাসে এসে আজ বিকাল ৫ টার মধ্যে জবাবদিহি করতে হবে। একই সঙ্গে ডিএসডব্লিউ স্যার কেনো ঘটনাস্থল থেকে পলায়ন করেছেন তা উনাকে আজ বিকাল ৫ টার মধ্যে সকলের সামনে জবাবদিহি করতে হবে।
৫। আবাসিক হলগুলোতে র্যাগের নামে এবং ভিন্ন মতাবলম্বীদের উপর সকল প্রকার শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন বন্ধে জড়িত সকলের ছাত্রত্ব বাতিল করতে হবে। একই সাথে আহসানউল্লা হল এবং সোহরাওয়ার্দী হলের পূর্বের ঘটনাগুলোতে জড়িত সকলের ছাত্রত্ব বাতিল ১১ নভেম্বর, ২০১৯ তারিখ বিকাল ৫ টার মধ্যে নিশ্চিত করতে হবে।
৬। রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে আবাসিক হল থেকে ছাত্র উৎখাতের ব্যাপারে অজ্ঞ থাকা এবং ছাত্রদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হওয়ায় শেরে বাংলা হলের প্রভোস্টকে ১১ নভেম্বর, ২০১৯ তারিখ বিকাল ৫ টার মধ্যে প্রত্যাহার করতে হবে।
৭। মামলা চলাকালীন সকল খরচ এবং আবরারের পরিবারের সকল ক্ষতিপূরণ বুয়েট প্রশাসনকে বহন করতে হবে।
উল্লেখ্য, ভারতবিরোধী স্ট্যাটাস দিয়ে ছাত্রলীগ নেতাদের হাতে খুন হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ। তার দ্বিতীয় নামাজের জানাজা কুষ্টিয়ায় নিজ এলাকায় সম্পন্ন হয়েছে।
মঙ্গলবার (৮ অক্টোবর) সকাল সাড়ে ৬টায় কুষ্টিয়া শহরের পিটিআই রোডস্থ আল-হেরা জামে মসজিদে ফাহাদের দ্বিতীয় জানাজা হয়।
ফাহাদের ছোট ভাই আবরার ফাইয়াজ জানিয়েছে, সকাল ১০টায় ৩য় জানাজা শেষে আবরার ফাহাদের গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালীর উপজেলার কয়া ইউনিয়নের রায়ডাঙ্গা কবরস্থানে দাফন করা হবে।
সোমবার (৭ অক্টোবর) রাত ১০টার দিকে বুয়েট ক্যাম্পাসে তার জানাজা সম্পন্ন হয়। এরপর তার মরদেহ বাবা বরকতুল্লাহর কাছে হস্তান্তর করে পুলিশ। রাতেই তিনি সন্তানের মরদেহ নিয়ে কুষ্টিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন।
এর আগে সোমবার (৭ অক্টোবর) ভোর ৪টার দিকে ফাহাদের মৃতদেহটি উদ্ধার করে পুলিশ। পরে ময়নাতদন্তের জন্য মৃতদেহটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের মর্গে পাঠায় পুলিশ।
আবরার ফাহাদ ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র ছিলেন। তিনি শেরেবাংলা হলেই থাকতেন। আবরারকে পেটানোর ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল ও সহ-সভাপতি মুস্তাকিন ফুয়াদকে আটক করেছে পুলিশ।
প্রত্যক্ষদর্শী ও হলের আবাসিক শিক্ষার্থীরা জানান, রাত ১১টার দিকে আবরারকে ২০১১ নম্বর কক্ষে ডেকে নিয়ে যায় ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। এর পর তাকে জেরা করতে করতে পেটাতে থাকে নেতা-কর্মীরা। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আইনবিষয়ক উপ-সম্পাদক ও সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী অমিত সাহা, উপ-দফতর সম্পাদক ও কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী মুজতাবা রাফিদ, সমাজসে বাবিষয়ক উপ-সম্পাদক ও বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী ইফতি মোশারফ ওরফে সকালসহ ছাত্রলীগের আরও কয়েকজন কর্মী সে দলে ছিলেন।
রহস্যজনক এই মৃত্যুর ৮ ঘণ্টা আগে ভারতকে সমুদ্র বন্দর, পানি ও গ্যাস দেয়ার চুক্তির বিরোধিতা করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন নিহত বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদ।
সোমবার (৭ অক্টোবর) ভোর ৪টার দিকে মৃতদেহটি উদ্ধার করেছে পুলিশ। পরে ময়নাতদন্তের জন্য মৃতদেহটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের মর্গে পাঠায় পুলিশ।
গত শনিবার বিকাল সাড়ে ৫ টায় ওই স্ট্যাটাসের পর আজ মধ্যরাতে ফাহাদের মৃত্যুর খবর পায় তার পরিবার।
ওই স্ট্যাটাস আজ সকাল ১১টা পর্যন্ত ৯ হাজার লাইক ও তিন হাজারেরও বেশি শেয়ার হয়েছে।
পাঠকদের জন্য ফেসবুকে দেওয়া আবরারের শেষ স্ট্যাটাসটি তুলে ধরা হলো-
‘‘১. ৪৭ এ দেশভাগের পর দেশের পশ্চিমাংশে কোনো সমুদ্রবন্দর ছিল না। তৎকালীন সরকার ৬ মাসের জন্য কলকাতা বন্দর ব্যবহারের জন্য ভারতের কাছে অনুরোধ করল। কিন্তু দাদারা নিজেদের রাস্তা নিজেদের মাপার পরামর্শ দিছিলো। বাধ্য হয়ে দুর্ভিক্ষ দমনে উদ্বোধনের আগেই মংলা বন্দর খুলে দেওয়া হয়েছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজ ইন্ডিয়াকে সে মংলা বন্দর ব্যবহারের জন্য হাত পাততে হচ্ছে।
২. কাবেরি নদীর পানি ছাড়াছাড়ি নিয়ে কানাড়ি আর তামিলদের কামড়াকামড়ি কয়েক বছর আগে শিরোনাম হয়েছিল। যে দেশের এক রাজ্যই অন্যকে পানি দিতে চায় না সেখানে আমরা বিনিময় ছাড়া দিনে দেড় লাখ কিউবিক মিটার পানি দিব।
৩. কয়েক বছর আগে নিজেদের সম্পদ রক্ষার দোহাই দিয়ে উত্তর ভারত কয়লা-পাথর রপ্তানি বন্ধ করেছে অথচ আমরা তাদের গ্যাস দিব। যেখানে গ্যাসের অভাবে নিজেদের কারখানা বন্ধ করা লাগে সেখানে নিজের সম্পদ দিয়ে বন্ধুর বাতি জ্বালাব।
হয়তো এ সুখের খোঁজেই কবি লিখেছেন-
‘পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি
এ জীবন মন সকলি দাও
তার মতো সুখ কোথাও কি আছে
আপনার কথা ভুলিয়া যাও।’’
চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কমকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ সোহরাব হোসেন ব্রেকিংনিউজকে জানান, আজ সোমবার ভোরে শেরে বাংলা হলের সিঁড়ি থেকে এক শিক্ষার্থীর মরদেহ উদ্ধার করেছেন তারা। মধ্য রাতের দিকে তার মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আবরারের পায়ে এবং হাতে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে বলেও জানান তিনি।
এ ঘটনায় ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, পুলিশ ঘটনাটি খতিয়ে দেখছে। হল প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের সব ধরনের সহায়তা করা হবে।
বুয়েটের ডাক্তার মাসুক এলাহী বলেন, রাত ৩টার দিকে হলের শিক্ষার্থীরা আমাকে ফোন দেয়। আমি হলে গিয়ে সিঁড়ির পাশে ছেলেটিকে শোয়ানো অবস্থায় দেখতে পাই। ততক্ষণে ছেলেটি মারা গেছে।
মৃত ফাহাদের গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়া সদর উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা রোডে। বাবার নাম বরকত উল্লাহ। সে বুয়েটের ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিল এবং শেরেবাংলা হলের ১০১১ নম্বর কক্ষে থাকতো।