লকডাউনে কর্মহীন লাখো দিনমজুর, সরকারি ত্রাণ কতদূর?

করোনা মোকাবিলায় সারাদেশের মতো রংপুর বিভাগেও চলছে সরকার ঘোষিত লকডাউন। জনসমাগম রোধে চলাফেরায় কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হলেও শ্রমজীবী মানুষের আনাগোনা কমেনি।
লকডাউনে শ্রম বিক্রির ক্ষেত্রগুলো বন্ধ থাকায় রংপুর ও দিনাজপুর অঞ্চলের বেশির ভাগ দিনমজুর ও শ্রমজীবী মানুষ আয় রোজগার থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়েছেন। এই পরিস্থিতিতে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দিনমজুরেরা। লকডাউনের কারণে রংপুর বিভাগের আট জেলার প্রায় ৫ লাখ কৃষি মৌসুমি শ্রমিক চলতি মৌসুমে বোরো ধান কাটা মাড়াইয়ে অংশ নিতে দেশের অন্য জেলাগুলোতে যেতে পারছে না। ফলে করোনা দুর্যোগে আড়াই’শ কোটি টাকা বাড়তি আয় থেকে বঞ্চিত হয়েছে এ বিভাগের মৌসুমি শ্রমিকরা।
এ দিনমজুররা লকডাউনের কবলে পড়ে ঘরে বসে অলস সময় পার করছেন। হঠাৎ কর্মহীন হয়ে পড়ায় দিনমজুরেরা জীবিকা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। দিনে এনে দিনে খাওয়া এসব দিনমজুর মানুষ চোখে শর্ষে ফুল দেখার মত অবস্থা তৈরি হয়েছে। লকডাউন দিন দিন যতই সামনে এগিয়ে যাচ্ছে ততই বাড়ছে এসব মানুষগুলোর অভাব।
তবে কৃষি বিভাগ বলছে করোনা দুর্যোগে এ পর্যন্ত ৪ হাজার শ্রমিক দেশের অন্যত্র ধান কাটতে গিয়েছেন। এর মধ্যে বিভাগের কোন কোন উপজেলা লকডাউনের মাঝেই শ্রমিক পাঠানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। গত সোমবার গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা থেকে প্রথম ধাপে ৩০ জন শ্রমিক পাঠানোর খবর পাওয়া গেছে।
জানা যায়, প্রতি বছর এপ্রিল মাসে রংপুর বিভাগের রংপুর, দিনাজপুর, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, নীলফামারীসহ সব জেলা থেকে দলে দলে বিভক্ত হয়ে দিনমজুরেরা দেশের দক্ষিণের জেলা কুমিল্লা, নোয়াখালি, লক্ষীপুর, ফেনী, চাঁদপুর, বরিশাল ও বগুড়া, চাপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহীসহ বিভিন্ন জেলায় শ্রম বিক্রি করতে যায়। কিন্তু এবার লকাডাউনের ফলে তা সম্ভব হচ্ছে না এসব দিনমজুরদের। এছাড়াও এবার রয়েছে ঈদ আনন্দ। ঠিক মতো কাজ না পেলে এসব দিনমজুর পরিবারের ঈদ আনন্দ মলীন হয়ে পড়বে।
রংপুর কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, রংপুর ও দিনাজপুর অঞ্চলে সাড়ে ৫ লাখের ওপর মৌসুমি শ্রমিক রয়েছে। এসব মৌসুমি শ্রমিক ধানের মৌসুমে শুধু নিজ জেলার বাইরে অন্য জেলায় গিয়ে কাটা মাড়াই করে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা বাড়তি আয় করে। সেই হিসেবে বোরো মৌসুমেই এই বিভাগে প্রায় ৫ লাখ মৌসুমি শ্রমিক আড়াইশ কোটি টাকা আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার দিনমজুর আ. মকিম বলেন, ‘হামরা তো প্রতি বছর এই সমায় দলের লোক নিয়া বিভিন্ন জেলায় জাই এবার তো আর যাওয়া সম্ভব হইল না।’
একই উপজেলার চর ইছলী গ্রামের নুর হোসেন ও সাগর মিয়া বলেন, ‘লকডাউনের কারণে বউ-ছাওয়াল নিয়া বাড়িত আছি। বাড়িত থাকলে যদি পেটোত ভাত যায় তাইলে তো কথা ছিল না। কিন্তু হামার তো একদিন কাম না করলে চুলাত হাঁড়ি উঠে না।’
রংপুর নগরীর শাপলা চত্বরে কথা হয় আবুল মিয়া (৩৫) সাথে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, তিন সন্তানসহ ছয় সদস্যের পরিবার মোর। প্রতিদিন বদরগঞ্জ থেকে প্রায় ১৮-২০ কিলোমিটার রাস্তা সাইকেল চালিয়ে কাজের জন্য এই শহরে আইসি। সারা দিন কাজ করে সন্ধ্যায় ৫০০ টাকা হাজিরা নিয়ে ঘরে ফিরি। আর এই টাকা দিয়েই খরচ হয় পুরো পরিবারের জন্য। তাও কোনো দিন কাজ মিলে, কোনো দিন মিলে না। এর মধ্যে সরকার হঠাৎ করি লকডাউন দিছে।
কুড়িগ্রামের শ্রমিক আমিনুল ইসলাম বলেন, পেটে ক্ষুধার জ্বালা থাকলে কি লকডাউন মানে? করোনা খালি বড় লোকের ভয় না, আমাদের মত গরীব খেটে খাওয়া মানুষেরও ভয়। কিন্তু কাজ না মিললে আমাদের পেটে ভাত যায় না। সরকার তো আমাদের পেটের খোঁজ রাখে না।
ঠাকুরগাঁওয়ের শ্রমিক মো. কালাম বলেন, গতবার লকডাউনে কিছুটা হলেও ত্রাণ পেয়েছিলাম। এবার তারও আর কোনো আনাগোনা দেখছি না। কোনো কাজও হচ্ছে না। বউ-বাচ্চা নিয়ে কীভাবে রোজার মাস পার করবো বুঝতেছি না। আর ঈদের আগে লকডাউন সবকিছুই বন্ধ এলাকার চেয়ারম্যান-মেম্বারও খবর নিচ্ছে না। এবারে আর ঈদের আগে বাইরত জাওয়া জওয়ী বন্ধ কি যে করমো চিন্তা করি পাওনা।
দিনাজপুর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে কথা হয় বাস হেলপার নুরুল হকের সাথে। তিনি বলেন, লকডাউনে সরকার বাস বন্ধ রাখছে। সবকিছুই চলতেছে শুধু বাস বন্ধ। এখানে কাজ করে প্রতিদিন যে টাকা পাইতাম তা দিয়ে আমার সংসার চলে। সামনে ঈদ আসতেছে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি ঈদের সময় সেমাই-চিনি কাপড় দিতে হবে মেয়েকে মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে। যদি বাস না চলে কীভাবে কি করব ভাবতে পারতে না। সরকারও আমাদেরকে সহযোগিতা করতেছে না।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক খন্দকার আব্দুল ওহাব জানান, এ পর্যন্ত ৪ হাজারের মত শ্রমিক ধান কাটতে দেশের অন্যান্য স্থানে গিয়েছে। আরও শ্রমিক পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে।