নৌকার প্রার্থীরা জাপাকে ছাড় দিতে নারাজ

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতীয় পার্টির (জাপা) মধ্যে আসন সমঝোতার আলোচনা চলমান রয়েছে। এই আলোচনার মধ্যেই জানা গেছে, গত দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো এবার জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের ছাড় দিতে নারাজ আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন বিভিন্ন আসনের স্বতন্ত্র ও ডামি প্রার্থীরাও। জাপার হেভিওয়েট নেতাদের আসনে আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলে এই মনোভাবের কথা জানা গেছে।
আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয়ভাবে আসন ছাড়ের বিষয়ে জাপার সঙ্গে সমঝোতা করলে এই প্রার্থীরা কী করবেন, সে বিষয়ে প্রার্থীরা সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করেন। বিভিন্ন আসনের প্রার্থীরা বলছেন, ভোটের মাঠে তারা জাপাকে একচুলও ছাড় দেবেন না।
রংপুর-৩ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী দলের চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদেরের (জি এম কাদের) বিপরীতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী তুষার কান্তি মণ্ডল। ১৯৭৩ সালের পরে এই আসনটি দখলে রেখেছে জাতীয় পার্টি। ১৯৮৬ সালের পর থেকে জাতীয় পার্টি এই আসনে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করেছে। রংপুর মহানগর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য তুষার কান্তি মণ্ডল বলেন, ‘এই আসনে যা কিছু উন্নয়ন হয়েছে, তার মূলে রয়েছে আওয়ামী লীগ। এই আসনের এমপি প্রার্থী জি এম কাদের সাহেব তো ছিলেন লালমনিরহাটে। তিনি সেখানে কোনো উন্নয়ন করতে পারেননি।’
জি এম কাদেরর প্রতিপক্ষ হিসেবে এই আসনে আরও রয়েছেন জাকের পার্টির লায়লা আঞ্জুমান আরা বেগম, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের মো. সহিদুল ইসলাম, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির শফিউল আলম, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির মো. আব্দুর রহমান রেজু, স্বতন্ত্র প্রার্থী মোছা. আনোয়ারা ইসলাম রানী। তারাও জাপা চেয়ারম্যানকে ছাড় দেবেন কি না, সে নিশ্চয়তা নেই। তবে জি এম কাদেরকে বিজয়ী হতে হলে এখন তাদের মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে হবে।
কিশোরগঞ্জ-৩ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী নাসিরুল ইসলাম খানের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা জমে উঠেছে জাপা মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নুর। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের সঙ্গে আসন সমঝোতায় ২০০৮ সাল থেকে এই আসনের এমপি মো. মুজিবুল হক চুন্নু। এ আসনে মনোনয়নপত্র দাখিলের পরে মামলাসংক্রান্ত দলিল দিতে না পারায় নাসিরুল ইসলাম খানের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে যায়। পরে নির্বাচন কমিশনে আবেদন করে তিনি প্রার্থিতা পুনরুদ্ধার করেন গতকাল রবিবার। প্রার্থিতা ফিরে পেয়ে তিনি বলেছেন, ’চুন্নু ঋণখেলাপি, সেই তথ্য গোপন করেছেন। তার মনোনয়নপত্র বাতিল করা হোক।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘চুন্নুর সঙ্গে মাঠে খেলা হবে। চুন্নুর জামানত বাজেয়াপ্ত হবে।’ এর জবাবে মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, ‘আমি ঋণখেলাপি নই, ২০১২ সালের পরে আমি কারও জামিনদার হইনি।’
নাসিরুলের মন্তব্যের জবাবে জাপা মহাসচিব বলেন, ‘আমি নির্বাচনে নৌকা প্রার্থীকে সরিয়ে দিয়ে নির্বাচন করব এই ধরনের মানসিকতা আমার নেই এবং কখনো ছিল না। আমি নৌকার সঙ্গে একবার না, তিনবার নির্বাচন করেছি। সেসব নির্বাচনে সেখানে নৌকার উপযুক্ত প্রার্থী ছিলেন।’
ঢাকা-৬ আসনে গত দুবারের সংসদ সদস্য জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদের আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন। এবার এমপি হিসেবে বিজয়ের আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, ‘২০১৫ সালে আমি যখন মেয়র নির্বাচন করি, তখন জাতীয় পার্টিরও একজন প্রার্থী ছিলেন। তিনি আমাকে নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার জন্যও অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু আমি সরে যাইনি। সেবার নির্বাচনে সাড়ে ১৮ লাখ ভোটের মধ্যে আমি পাই ৫ লাখ ৩৫ হাজার ভোট, জাতীয় পার্টির সেই প্রার্থী পেয়েছিলেন ২ হাজার ৬০০ ভোটের মতো। সুতরাং হিসাব করলেই বোঝা যাবে, কোন দলের কত ভোট।’ কাজী ফিরোজ রশীদ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আসন সমঝোতার বিষয়টি নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের ব্যাপার, এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করব না। তবে আমি বলতে পারি, যে ৯ জন প্রার্থী রয়েছি এই আসনে, তাদের সবার মধ্যেই একটা শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে।’
কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘এই আসনে ১০ বছর ধরে আমি এমপি। নতুন কেউ এসে মাত্র এক মাস মাঠে থেকে বলবে, আমি জিতে যাব; ব্যাপারটা এত সোজা না। তবে এই আসনে এবারের নির্বাচন বেশ কঠিন হবে।’
মহাজোটের শরিক হওয়ার পরে দশম এবং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৪ আসনের সংসদ সদস্য হন জাপার কো-চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা। এই আসনে বাবলার শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য সানজিদা খানম। আসন পুনরুদ্ধারের বিষয়ে প্রত্যাশা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, ‘মহাজোটের সঙ্গে বনিবনা করে সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা দুবার এমপি হয়েছেন। আমরাই নিজেদের লোক দিয়ে তার পোলিং এজেন্ট নিয়োগ দিয়েছি। ১০ বছর ধরে বাবলা সাহেব এলাকার কোনো উন্নয়ন করেছেন, তা বলতে পারবেন না। তার একটা ভোটারও নাই এলাকায়। ভোটে পাস করার কোনো আশা নাই।’ গতকাল সন্ধ্যায় এই বিষয়ে সৈয়দ আবু হোসেন বাবলার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বৈঠকে আছেন জানিয়ে ফোন কল কেটে দেন।
জাপার সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ চট্টগ্রাম-৫ (হাটহাজারী) আসনে দলের মনোনয়ন পেয়েছেন ওই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আবদুস সালাম। আসনে সমঝোতা না হলে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে নৌকার প্রার্থী এগিয়ে থাকবেন বলে মনে করছেন এই আসনের রাজনীতিবিদরা।
জাপার আরেক প্রভাবশালী নেতা প্রেসিডিয়াম সদস্য গোলাম কিবরিয়া টিপু বরিশাল-৩ আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন। তার বিপরীতে সরদার মো. খালেদ হোসেন আওয়ামী লীগের টিকিট পেয়েছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে রয়েছেন বাবুগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আতিকুর রহমান। তিনি বলেন, ‘সমঝোতা হলো কি না, আমার এ বিষয়ে জানার দরকার নাই। আমি নির্বাচন করব।’
নীলফামারী-৩ আসনে জাপার এমপি রানা মোহাম্মদ সোহেলের সঙ্গে নৌকা প্রতীকে লড়বেন জলঢাকা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক এমপি মো. গোলাম মোস্তফা। তিনি বলেন, ‘এবার আমি জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী। দল যদি আমার ওপর আস্থা রাখে কথা দিচ্ছি, এবার নৌকা প্রতীকের জনমতের প্রতিফলন ঘটবে, আমাদের ভূমিধস বিজয় হবে।’
বগুড়া-২ আসনে শরিফুল ইসলাম জিন্নাহর বিপরীতে আওয়ামী লীগের তৌহিদুর রহমান মানিক, বগুড়া-৩ আসনে নুরুল ইসলাম তালুকদারের বিপরীতে মো. সিরাজুল ইসলাম খান রাজু আওয়ামী লীগের টিকিটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
তৌহিদুর রহমান মানিক বলেন, ‘সমঝোতা হলে হবে। আমি মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে রাজি না। আমি শিবগঞ্জ পৌরসভার মেয়রের পদ থেকে পদত্যাগ করে নির্বাচনে এসেছি। আমি সরে যাব না।’ সিরাজুল ইসলাম খান রাজু বলেন, ‘এই আসনে জাতীয় পার্টির এক পার্সেন্ট ভোটও নাই। এই আসনের ভোটারদের দীর্ঘদিনের আশা, আবার নৌকা প্রতীকের প্রার্থী এমপি হবেন। আদমদীঘি উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলাম গত দুবার। আমি যে উন্নয়ন করেছি, এমপি সাহেব তো তার ধারেকাছেই নাই।’
রংপুর-১ আসনে জাতীয় পার্টি এবার দল থেকে বহিষ্কৃত মসিউর রহমান রাঙ্গাকে মনোনয়ন দেয়নি। রাঙ্গা এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। তার বিপরীতে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হোসেন মকবুল শাহরিয়ার আসিফ। এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. রেজাউল করিম রাজু। রাঙ্গা বলেন, ‘জাতীয় পার্টির সঙ্গে আওয়ামী লীগের সমঝোতা হলে হবে। আমাকে চাপ দিয়ে লাভ নাই। আমি নির্বাচন করব। আমি তিস্তাপাড়ে যে উন্নয়ন করেছি, তার ধারাবাহিকতা রাখতে জনগণ আমাকে বেছে নেবেন।’
ঢাকা-১ আসনে জাপার সালমা ইসলামের বিপরীতে আওয়ামী লীগের সালমান এফ রহমান, ঢাকা-১৭ আসনে জি এম কাদের ও সালমা ইসলামের বিপরীতে আরাফাত এ রহমান; ময়মনসিংহ-৮ আসনে জাপার ফখরুল ইমামের বিপরীতে রয়েছেন মো. আব্দুছ ছাত্তার; বরিশাল-৬ আসনে লড়বেন জাপার নাসরিন জাহান রতনার বিপরীতে আবদুল হাফিজ মল্লিক; ফেনী-৩ আসনে জাপার মাসুদউদ্দিন চৌধুরীর বিপরীতে মো. আবুল বাশার; নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনে লিয়াকত হোসেন খোকার বিপরীতে আব্দুল্লাহ আল কায়সার; কুড়িগ্রাম-২ আসনে পনির উদ্দিন আহমেদের বিপরীতে মো. জাফর আলী; সুনামগঞ্জ-৪ আসনে পীর ফজলুর রহমানের বিপরীতে মোহাম্মদ সাদিক; নীলফামারী-৪ আসনে আহসান আদেলুর রহমানের বিপরীতে মো. জাকির হোসেন বাবুল, পিরোজপুর-৩ আসনে মো. মাশরেকুল আজিম রবির বিপরীতে মো. আশরাফুর রহমান আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মাঠে রয়েছেন।