অভিযানের নাম কেন ‘ডেভিল হান্ট’, টার্গেট কারা?

আড্ডার হুল্লোড় কিংবা অলি-গলিতে উত্তপ্ত রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্কে; একটা নামই চায়ের কাপে ঝড় তুলছে—অপারেশন ডেভিল হান্ট! এই অপারেশনের ব্যাপ্তি যা-ই হোক; নামের মধ্যে ভীত সন্ত্রস্ত হওয়ার সমস্ত উপকরণ রয়েছে। জনমনে প্রশ্ন, ‘হুট করেই কেন এমন নামে অভিযান?’ ‘কেন এই নাম রাখা হলো?’
অপারেশন ডেভিল হান্ট একটি বিশেষ যৌথ অভিযান, যা বাংলাদেশ সরকার গত ৮ ফেব্রুয়ারি শুরু করেছে। এই অভিযানের মূল উদ্দেশ্য হলো সন্ত্রাসবাদ দমন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করা এবং অপরাধীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা। বিশেষ করে, গাজীপুরের সাম্প্রতিক সহিংস ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এই অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। খবর: বাংলাদেশ গার্ডিয়ান
অভিযানটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ পুলিশ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-সহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যৌথভাবে পরিচালনা করছে। তারা সম্মিলিতভাবে সন্ত্রাসীদের শনাক্ত ও গ্রেফতার, জনসাধারণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও দমনে কাজ করবে এই অপারেশনের আওতায়।
‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ মানে কী?
এখনো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিকভাবে এই নামকরণের ব্যাখ্যা দেয়নি। তবে সামরিক ও বিশেষ বাহিনীগুলো সাধারণত তাদের অপারেশনের জন্য শক্তিশালী, ভয়ংকর ও মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব সৃষ্টি করে এমন নাম নির্বাচন করে, যাতে অপরাধীরা ভীত সন্ত্রস্ত হয় এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে অভিযান সম্পর্কে আগ্রহ ও আস্থা তৈরি হয়।
‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ নামটি নির্বাচন করার নেপথ্যে বেশ কিছু কারণ থাকতে পারে—
‘ডেভিল’ (শয়তান): এটি সাধারণত অপরাধী, সন্ত্রাসী, বা সমাজবিরোধী কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত প্রতীকী শব্দ। এই নামের মাধ্যমে ইঙ্গিত দেওয়া হতে পারে যে অভিযানটি রাষ্ট্রবিরোধী, অপরাধী বা সন্ত্রাসীদের নির্মূল করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত হচ্ছে।
‘হান্ট’ (শিকার): এর অর্থ হলো শিকার করা বা অনুসন্ধান করে ধ্বংস করা। এখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্রিয় অভিযান ও অভিযানকৃত ব্যক্তিদের ধরার প্রতীক হিসেবে এই শব্দ ব্যবহৃত হতে পারে।
বলে রাখা ভালো, সামরিক বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের নামকরণ অনেক সময় আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট থেকে অনুপ্রাণিত হয়। ‘ডেভিল হান্ট’ নামটি সম্ভবত সন্ত্রাসবাদ বা অপরাধ দমনের অন্যান্য অভিযানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে রাখা হয়েছে।
নামটি কীভাবে এলো, কতদিন চলবে অভিযান-
গত শনিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর সমন্বয়ে অনুষ্ঠিত সভা থেকে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সবা শেষে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, গাজীপুরে ছাত্র-জনতার ওপর সন্ত্রাসী আক্রমণের ঘটনায় আজ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সমন্বয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় সংশ্লিষ্ট এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে ও সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনতে যৌথ বাহিনীর সমন্বয়ে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ পরিচালনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।
অতএব, এই নাম আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর সমন্বয়ে অনুষ্ঠিত সভা থেকেই নির্ধারণ করা হয়েছে। ওই সভার আগে এ ধরনের কোনো অভিযানের নাম শোনা যায়নি।
অপারেশন ডেভিল হান্ট কতদিন চলবে, এমন প্রশ্নে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ অভিযানটি অপরাধীদের সম্পূর্ণ নির্মূল না করা পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।’ তিনি বলেন, ‘ডেভিল যতদিন শেষ না হবে, ততদিন পর্যন্ত অপারেশন চলবে।’
অভিযানটি শনিবার থেকে শুরু হয়েছে এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তবে, নির্দিষ্ট সময়সীমা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রদান করেনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। অতএব, এই অভিযান দীর্ঘদিন ধরে চলার সম্ভাবনা রয়েছে।
এমন অভিযান প্রথম নয়-
২০০৭ সালে ‘ওয়ান ইলেভেন’ হিসেবে পরিচিত সরকারের সময়ও এই ধরনের অপারেশন পরিচালনা করা হয়। সেবার যৌথবাহিনীর সেই অভিযানের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ অপারেশন র্যাপিড ফ্রিডম’। ওই অভিযানের মাধ্যমে যৌথবাহিনী রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সন্ত্রাস দমনে কাজ করেছিল। সে অভিযানে রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আমলাসহ বিভিন্ন পেশাজীবীদের আটক করা হয়েছিল।
তবে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত অভিযান ছিল ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’। ২০০২-০৩ সালে এই অভিযান পরিচালিত হয়। তখন রাষ্ট্রক্ষমতায় বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট সরকার। দেশে তখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে। পরিস্থিতি দিনকে দিন খারাপের দিকে যাচ্ছিল। মানুষের মনে আতঙ্ক, উদ্বেগ, ক্ষোভ আর হতাশা জন্ম নিয়েছিল। ঠিক সেই প্রেক্ষাপটে অপারেশন ক্লিনহার্ট পরিচালনা করা হয়। এবং তাতে সফলতাও আসে।
এছাড়াও ২০১৬-২০১৭ সালে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস দমনের জন্য আরো বেশ কিছু অভিযান পরিচালনা করা হয়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, অপারেশন প্যাথফাইন্ডার, অপারেশন সানডাউন, অপারেশন স্টর্ম-২৬, অপারেশন ঈগল হান্ট, অপারেশন হিট ব্যাক, অপারেশন ম্যাক্সিমাম এক্সপ্রেশন, অপারেশন টোয়াইলাইট।