যমুনার বুকে দেশের দীর্ঘতম রেলসেতু, সাড়ে ৩ মিনিটেই পার

ঢাকা ও দেশের পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে রেল যোগাযোগে যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে এলো যমুনা রেলসেতু। পূর্বে যমুনা বহুমুখী সেতুর মাধ্যমে রেল চলাচল সম্ভব হলেও ট্রেনের দীর্ঘ অপেক্ষা ও ধীরগতির কারণে যাত্রীদের দুর্ভোগ পোহাতে হতো। তবে যমুনার বুকে দেশের দীর্ঘতম ডাবল লাইন রেলসেতুর মাধ্যমে সেই দুর্ভোগের অবসান ঘটেছে।
আজ মঙ্গলবার (১৮ মার্চ) আনুষ্ঠানিকভাবে এই সেতুর দুটি লাইনে ট্রেন চলাচল শুরু হচ্ছে। এর আগে ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে একটি লাইনে পরীক্ষামূলকভাবে ট্রেন চলছিল। রেলের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এখন থেকে মাত্র সাড়ে তিন মিনিটেই একটি ট্রেন যমুনা রেলসেতু পার হতে পারবে এবং আর কোনো ট্রেনকে অপেক্ষায় থাকতে হবে না।
রোববার রাতে যমুনা রেলসেতু দিয়ে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে কলেজ শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম ফেসবুকে লিখেছেন, ‘এই এক সেতু পার হতে এক-দেড় ঘণ্টা লেগে যেত। আর আজ সেতু পার হলাম তিন মিনিটে। রেলপথে নতুন বাংলাদেশের সূচনা করেছে যমুনা রেলসেতু।’
চার বছরের নির্মাণযাত্রা-
২০২০ সালের ২৯ নভেম্বর যমুনা রেলসেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের মাধ্যমে এর নির্মাণকাজ শুরু হয় এবং প্রায় সাড়ে চার বছর পর তা বাস্তবে রূপ নেয়। প্রকল্পের অধীনে নির্মিত হয়েছে ৪.৮ কিলোমিটার দীর্ঘ মূল সেতু, উভয় পাশে ০.৫ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট (উড়ালপথ), ৭.৬৭ কিলোমিটার রেলওয়ে অ্যাপ্রোচ এমব্যাংকমেন্ট এবং লুপ সাইডিংসহ ৩০.৭৩ কিলোমিটার রেললাইন। একইসঙ্গে সেতুর দুই পাড়ের স্টেশন আধুনিকীকরণ, রেলওয়ে ব্রিজ মিউজিয়াম নির্মাণ, সেতু রক্ষণাবেক্ষণ কর্মীদের জন্য অফিস ও আবাসন এবং নদী শাসন কার্যক্রমও প্রকল্পের আওতায় সম্পন্ন হয়েছে।
নতুন সেতুর সুফল-
বাংলাদেশ রেলওয়ের মতে, এই সেতু চালুর ফলে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে ট্রেন চলাচলে আর কোনো বিলম্ব হবে না। পূর্বের মতো ট্রেনগুলোকে স্টেশনে অপেক্ষা করতে হবে না, ফলে যাত্রার সময় অন্তত ২০ মিনিট কমবে।
এই সেতু দিয়ে মিটার গেজ ও ব্রড গেজ উভয় ট্রেন চলবে, যেখানে ব্রড গেজ ট্রেন ১২০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা এবং মিটার গেজ ট্রেন ১০০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায় চলতে পারবে। পাশাপাশি, রেলওয়ের লাইন ক্যাপাসিটি বাড়ায় এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি যাত্রীবাহী ও পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল করতে পারবে। বর্তমানে যেখানে ৩৮টি ট্রেন চলাচল করছে, সেখানে নতুন সেতুর ফলে এই সংখ্যা বেড়ে ৮৮টি হবে।
নতুন রেলসেতুর মাধ্যমে কনটেইনার ট্রেন পরিচালনাও সম্ভব হবে, যা রেলওয়ের রাজস্ব আয় বাড়াবে। পাশাপাশি, উন্নত সিগনালিং ও ইন্টারলিংক ব্যবস্থা রেল পরিচালনার দক্ষতা বৃদ্ধি করবে। যাত্রীদের জন্য নিরাপদ ও নিরবচ্ছিন্ন ট্রেন চলাচল নিশ্চিত হবে, ফলে রেলভ্রমণের প্রতি আগ্রহ বাড়বে। দুর্ঘটনার সংখ্যা কমবে এবং যানজট ও বায়ুদূষণ হ্রাস পাবে।
এছাড়া, সেতুর সঙ্গে গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন সংযুক্ত করায় জনসাধারণ আরও বেশি গ্যাস ব্যবহারের সুবিধা পাবে। পূর্বাঞ্চলের ডেড লোকোমোটিভগুলো পার্বতীপুরের কেন্দ্রীয় লোকোমোটিভ কারখানায় সহজে পরিবহন করা যাবে, যা রেলের রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থাকে আরও কার্যকর করে তুলবে।
নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন-
যমুনা রেলসেতু শুধু ট্রেন চলাচলের জন্য নয়, বরং দেশের সামগ্রিক পরিবহন ব্যবস্থায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। দ্রুতগতির ট্রেন চলাচলের মাধ্যমে সড়কপথে চাপ কমবে, রেলওয়ের আয়ের পাশাপাশি অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
এ সেতু রেল যোগাযোগের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করল, যা দেশের ভেতর সংযোগ আরও সুদৃঢ় করবে এবং ভবিষ্যতে রেলভিত্তিক উন্নয়নের সম্ভাবনাকে আরও গতিশীল করবে।