July 30, 2025, 7:19 pm

আমার আর্মেনিয়ান সহপাঠী আরাকস এবং ঢাকায় শেষ ‘আরমানি’ পরিবার

Reporter Name 183 View
Update : Friday, October 12, 2018

রাশিয়ার গণমৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছে আরাকস নবহানিসয়ান। প্রথম ক্লাসেই মেয়েটির ‘সহযোগী ভাবাপন্ন মন’ মুগ্ধ করেছে আমাকে। সম্ভবত এ কারণেই অল্পতেই বন্ধুত্ব হয়ে গেছে আমাদের মধ্যে।রাশিয়ান-আর্মেনিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাইকোলজি নিয়ে পড়াশোনা শেষ করেছে আরাকস। পড়াশোনা নিয়ে কথা প্রসঙ্গে বললাম, ‘তুমি তো মনের চিকিৎসক!’ মিষ্টি হাসিতে জবাব দিলো, ‘আমি জাস্ট সাইকোলজিস্ট।’

বাংলাদেশ এবং আর্মেনিয়া নিয়ে আমাদের আলাপ হয়। বাংলাদেশে ‘আরমানি’ বা আর্মেনিয়ানদের বসবাস নিয়ে ওকে জানাই। এই বিষয়ে আমি প্রতিবেদন করেছিলাম জেনে আপ্লুত হয় আমার ভিনদেশি বন্ধু। জানালাম, আমাদের অঞ্চলের শিক্ষা ব্যবস্থায় আরমানিদের বেশ অবদান রয়েছে। ঢাকায় পশ্চিমা ধারার ‘পোগজ স্কুল’ ওদের গড়া। ঢাকায় প্রথম ঘোড়ার গাড়িও এনেছিল ওরা। সুপরিচিত ‘রূপলাল হাউজ’ও ওদেরই প্রতিষ্ঠিত। ‘সোনালি আঁশ’ পাটকে দুনিয়ার সামনে তুলে ধরেছিল ওরা।

আরাকসের কাছ থেকে জানা গেলো, আর্মেনিয়ার একটি জেলার নামও নাকি ‘বাংলাদেশ’। তাদের পারিবারিক বন্ধনও আমাদের দেশের মতোই। নিজেদের সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখার টান আছে। দেশটির বেশিরভাগ মানুষ শহরে বাস করে। দেশটির আয়তন ১১ হাজার ৪৮৪ বর্গ মাইল। জনসংখ্যা মাত্র ৩০ লাখ। হিরার খনির জন্য বিখ্যাত। প্রধান ভাষা আর্মেনিয়ান ও রাশিয়ান। ছেলেদের গড় আয়ু ৭১ বছর এবং মেয়েদের ৭৭ বছর। কথা হয় আর্মেনিয়ান জেনোসাইড নিয়েও।

এবার আমার প্রতিবেদন নিয়ে জানতে চাইলো আরাকস। সে কথাগুলোই আবার নতুন করে বলার চেষ্টা করছি। ২০০৩ সালের প্রথমদিকে আর্মেনিয়া থেকে প্রকাশিত ‘এজেডজি’ পত্রিকায় ‘আর্মেনিয়ান ওয়ান্টেড ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়, ‘মাইকেল জোসেফ মার্টিন ও তার স্ত্রী ভেরোনিকা মার্টিন সম্ভবত বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় বসবাসকারী একমাত্র আরমানি পরিবার। সেখানে অষ্টাদশ শতাব্দীতে নির্মিত আর্মেনিয়ান চার্চটির দেখাশোনা করছেন মার্টিন। শহরটিতে আরমানিদের বসবাস শুরু হয় মধ্যযুগে। বর্তমানে কিছু স্মৃতিচিহ্ন ছাড়া সেখানে তাদের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে।’

২০০৫ সালের মে মাসে জোসেফ মার্টিনের স্ত্রী ভেরোনিকা মার্টিন মারা যান। পরে আমেরিকা প্রবাসী এক আরমানি, আসলিয়েনের হাতে ওই চার্চ রক্ষার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে ২০১৫ সালে কানাডা প্রবাসী মেয়েদের কাছে চলে যান তিনি।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, একসময় আরমানিদের বসতি ছিল ঢাকায়। তবে ঠিক কবে ঢাকায় এসেছিলেন তার কোনও সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। ঢাকায় প্রথম তারা বসতি স্থাপন করেন তৎকালীন নগরী থেকে পাঁচ মাইল দূরে তেজগাঁও এলাকায়। সেখানে সুন্দর একটি গির্জা নির্মাণ করেন তারা। ঢাকার বিভিন্ন স্থানে প্রাসাদোপম অনেক ভবন গড়ে তোলেন তারা।

নাজির হোসেনের ‘কিংবদন্তীর ঢাকা’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ১৮৩৮ সালে ঢাকায় ৪০টি আরমানি পরিবার ছিল। ‘বাংলাপিডিয়ায়’ বলা হয়েছে, ঊনবিংশ শতাব্দীতে এ অঞ্চলে আরমানিদের অবস্থানে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। বাংলাদেশে সঞ্চিত অর্থ-সম্পদসহ অনেকে পাড়ি জমান ইউরোপে। অনেকে পাড়ি জমান মধ্য এশিয়া ও ইরানে।

তেজগাঁওয়ে ‘আভেতিস’ নামে আরমানিদের একটি প্রাচীন সমাধি রয়েছে। এটির নির্মাণকাল ১৫ আগস্ট, ১৭১৪ সাল। সহজেই বোঝা যায়, এর অনেক আগেই ভাগ্য সুপ্রসন্ন করার তাগিদে ঢাকায় আসেন আরমানিরা। ঢাকায় আসা অনেক বিদেশি জনগোষ্ঠীর মধ্যে আরমানিরা ছিলেন বেশ প্রভাবশালী। ঐতিহাসিক মুনতাসীর মামুনের গবেষণা থেকে জানা যায়, অষ্টাদশ শতকে লবণ আর কাপড়ের ব্যবসার সূত্র ধরেই আরমানিদের ঢাকায় আসা। এছাড়া তারা পান, চিনি, গান পাউডার, আফিম, চামড়া ও পাটের ব্যবসা করতেন পুরোদমে। এদের মধ্যে অনেকের ছিল জমিদারি। ঢাকার যে এলাকায় তাদের বসতি আর ব্যবসা গড়ে ওঠে কালক্রমে তারই নাম হয়ে যায় ‘আরমানিটোলা’।

উনিশ শতকে ঢাকায় পরিচিত ও প্রভাবশালী পরিবার হিসেবে কয়েকটি আরমানি পরিবারের নাম পাওয়া যায়। সেগুলো হলো- পোগজ, আরাতুন, পানিয়াটি, স্টিফান, লুকাস, কোজা, মাইকেল, মানুক, হার্নি, সিরকোর ও সার্কিস। জমিদারি আর ব্যবসাই ছিল এদের বিত্তের মূল ভিত্তি। বিদেশি হয়েও এ দেশে তাদের জমিদারি কেনার কারণ হতে পারে আভিজাত্য অর্জন ও সমাজের শীর্ষে অবস্থান।

১৮৬৮ সালে ঢাকার জমিদারদের তালিকায় দেখা যায়, ছয়জন ইউরোপীয় জমিদারের মধ্যে পাঁচজনই ছিলেন আরমানি। ঢাকার বাইরে বরিশালেও ছিল এদের জমিদারি। ঢাকা শহরের বিভিন্ন সামাজিক কাজকর্ম, শিক্ষা বিস্তার আর সভা-সমিতির সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করেছিলেন আরমানিরা। পানি নিষ্কাশনের জন্য ধোলাইখালের কিছু অংশের পুনঃখনন এবং সেতু নির্মাণ, বাকল্যান্ড বাঁধ আর পোগজ স্কুলের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল তাদের হাতেই। ঢাকার প্রথম মিউনিসিপ্যাল কমিটিতে ছিলেন সার্কিস। ১৮৭৪-৭৫ সালে ঢাকা পৌরসভার ৯ কমিশনারের মধ্যে দুজন ছিলেন আরমানি, জেজিএন পোগজ ও এনপি পোগজ। আরমানিটোলায় রয়েছে আর্মেনিয়ান গির্জা।

আমার বন্ধু আরাকস নবহানিসয়ান মুগ্ধ হয়ে শুনছিলো বাংলাদেশে আরমানিদের কথা। এবার তার কাছে আর্মেনিয়ার ইতিহাস নিয়ে জানতে চাইলাম।

জানা গেল, তুরস্কের ঠিক পূর্বদিকের দেশটাই আর্মেনিয়া। উত্তরে রয়েছে জর্জিয়া, পুবে আজারবাইজান এবং দক্ষিণে ইরান। ভৌগোলিকভাবে আর্মেনিয়ার অবস্থান দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলে। আর্মেনিয়ার রাজধানী ইরেভান। রাজধানীর মাত্র ২৫ মাইল দূরে তুরস্কের পূর্বসীমান্ত। একসময় তুরস্কের ওসমানী খেলাফতের অধীন ছিল আর্মেনিয়া। ইরেভান শহর থেকে একটা পাহাড়ের চূড়া দেখা যায়। সে পাহাড়ের স্থানীয় নাম ‘আরারাত’। নব্বই দশকে ওই পাহাড়েই নুহের কিশতির কিছু ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গিয়েছিল বলে দাবি করেন একদল প্রত্নতত্ত্ববিদ।

চতুর্থ থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত আর্মেনিয়া বিভিন্ন বড় শক্তির শাসনাধীনে আসে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ইরানি, বাইজেন্টিনীয়, আরবীয়, মোঙ্গল এবং তুর্কি জাতি। ১৯১৮ থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত অল্প সময়ের জন্য এটি একটি স্বাধীন প্রজাতন্ত্র ছিল। কিন্তু ১৯২০ সালে কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় আসার পর ১৯২২ সালে ইউনিয়ন অব সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকের অংশে পরিণত হয়। ১৯৩৬ সালে এটি স্বায়ত্বশাসিত আর্মেনিয়ান সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হয়। ১৯৯১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে আর্মেনিয়া।

লেখক : পিএইচডি গবেষক, ইন্টারন্যাশনাল জার্নালিজম, পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো, রাশিয়া।


More News Of This Category
এক ক্লিকে বিভাগের খবর